কথা নিউজ সার্ভিস,আসানসোলঃ গত লোকসভা নির্বাচনে ইতিহাসে প্রথমবার তৃণমূলের আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের দখল এবং তিন লক্ষের বেশি ব্যবধানে শত্রুঘ্ন সিনহার জয়ের পরেই আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের দিকেই সবার চোখ। অতীতেও এই কেন্দ্রটি বারবারই ব্যতিক্রমী এবং বৈচিত্র্যময় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে বিভিন্ন কারণে। তারকা প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়ের পরপর দুবার জয়। তার দল ত্যাগ। মুনমুন সেনের মত তারকা প্রার্থীর পরাজয় এবং শেষমেষ মুম্বই সুপারস্টার শত্রুঘ্ন সিনহার আগমন, বিজেপির হাতছাড়া আসানসোল। এবারের লোকসভার ফল কি হবে সেদিকে তাকিয়ে সবাই। শত্রুঘ্ন সিনহা কি তাঁর জয়ের ধারা ধরে রাখতে পারবে, নাকি বিজেপি পুনরায় ঘরে ফেরাবে আসানসোলের আসন, নাকি বামেরা নতুন কোনও ক্যারিশমা করবে তৃণমূল আমলেও প্রাক্তন বাম বিধায়িকা জাহানারা খানকে নিয়ে, সেদিকেই নজর সবার। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রথমবার বিজেপি আসানসোলে জয়লাভ করে। বিজেপির তারকা প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূলের হেভি ওয়েট প্রার্থী দোলা সেনকে ৭০ হাজার ভোটে পরাজিত করেছিলেন। অন্যদিকে রাজ্যে পরিবর্তন হলেও আসানসোল শিল্পাঞ্চলে তখনও বাম বামেরা অস্তমিত হয়নি। সেই সময়কালে বামেদের প্রাক্তন সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরী সিপিএম প্রার্থী হয়ে ২ লক্ষ ৫৫ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু সব হিসেব উলট-পালট হয়ে যায় ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে। বিজেপির পুনরায় প্রার্থী হন বাবুল সুপ্রিয়। বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূলের তারকা প্রার্থী মুনমুন সেনকে ২ লক্ষ ভোটে পরাজিত করেন। বামেদের ভোট নেমে আসে মাত্র ৮৭ হাজারে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা ভালো। ২০১৪ সালে বাবুল সুপ্রিয় ভোট পেয়েছিলেন ৪ লক্ষ ১৯ হাজার ৯৮৩ টি ভোট। অথচ ২০১৯ সালে মুনমুন সেন ভোট পান ৪ লক্ষ ৩৫ হাজার ৭৪১ টি ভোট। অর্থাৎ ২০১৪ সালে বিজেপি যা ভোট পেয়েছিল ২০১৯-এ তার থেকেও বেশি ভোট পেয়ে কিন্তু পরাজিত হতে হয়েছিল মুনমুন সেনকে। কারণ বামেদের ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে পাওয়া ২ লক্ষ ৫৫ হাজার ভোটের বেশিরভাগটাই সুইফট হয়ে ঢুকে বিজেপির ভোট বাক্সে। কিন্তু যে পরিমাণ ভোট ২০১৯ সালে বিজেপি তার ঘরে নিয়ে আসতে পেরেছিল ২০২২-এর উপনির্বাচনে তা প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। ২০২১ সালে বিজেপি ছাড়েন বাবুল সুপ্রিয়। তৃণমূলে যোগ দেন। সভাবতই আসানসোলের সাংসদ পদ থেকেও তাকে ইস্তফা দিতে হয়। আর এরপরে ২০২২ সালে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আসানসোলে তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে আসেন তারকা শত্রুঘ্ন সিনহা। বিজেপির প্রার্থী হন আসানসোল দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। সমস্ত হিসেব-নিকেশ কে ভুল প্রমাণ করে শত্রুঘ্ন সিনহা ৩ লক্ষের বেশি ভোটে অগ্নিমিত্রা পালকে পরাজিত করেন। যদি ২০২২ এর উপনির্বাচনের ভোট বাক্সের দিকে দেখা যায় তাহলে শত্রুঘ্ন সিনহা, তৃণমূলের ২০১৯-এ প্রাপ্ত ভোট ৪ লক্ষ ৩৫ হাজার ৭৪১ থেকে ২ লক্ষ ২০ হাজার ভোট বেশী পেয়েছিলেন। আর অগ্নিমিত্রা ২০১৯ এর বিজেপির প্রাপ্ত ভোট থেকে ২ লক্ষ ৮০ হাজার ভোট কম পেয়েছিলেন। বামেরা ২০১৯ এর মতই প্রায় ২০২২ এ ভোট পায়। অর্থাৎ বিজেপির ঘরের ভোটের বিরাট অংশ চলে আসে তৃণমূলে। ফল, প্রথমবার আসানসোল লোকসভা দখল করে তৃণমূল। আসানসোল লোকসভার অন্তর্গত ৭ টি বিধানসভা। যার মধ্যে কুলটি এবং আসানসোল দক্ষিণ বিধানসভা বিজেপির দখলে। ২০২২ এর লোকসভার উপনির্বাচনে বিধানসভা ভিত্তিক ফল দেখলে, ৭ টির মধ্যে ৬ টি বিধানসভায় জয়লাভ করেছিল তৃণমূল। শুধুমাত্র কুলটি বিধানসভায় সামান্য কিছু ভোটে পরাজিত হয়েছিল তৃণমূল। অন্যদিকে নিজের বিধানসভা কেন্দ্র আসানসোল দক্ষিনেও কিন্তু হেরে গিয়েছিলেন বিজেপির লোকসভার প্রার্থী অগ্নিমিত্র পাল। সামনে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচন। কি ফলাফল হতে পারে?
শত্রুঘ্ন সিনহা ৩ লক্ষ ভোটে উপনির্বাচনে জিতেছেন সে দিক দিয়ে তার আত্মবিশ্বাস প্রবল। সেটা তার পজিটিভ দিক হলেও, তাঁকে সাংসদ হিসেবে আসানসোল তেমন পায়নি বলেই বিরোধীদের দাবি। অন্যদিকে আসানসোলের হয়ে একটিও সওয়াল করেননি তিনি সংসদে। আসানসোলের কোনও সমস্যা সমাধানে তিনি উদ্যোগী হননি। ধস পূনর্বাসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্তে সংস্থার বিলগ্নিকরণ বা খনির বেসরকারিকরণ ঠেকাতে বা খনি এলাকার জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে শত্রুঘ্ন সিনহাকে কোন বিতর্ক বা সওয়াল জবাবে অংশগ্রহন করতে দেখা যায়নি সংসদে। তাই উপনির্বাচনের ভোটের প্রতিফলন এবারের ব্যালটে নাও হতে পারে বলে খোদ তৃণমূলের অন্দরেই আশঙ্কা। শত্রুঘ্ন সিনহার বিপক্ষে প্রার্থী হয়েছেন বিজেপির সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া। বিচক্ষন রাজনীতিবিদ। ৬ বারের সাংসদ তিনি। দার্জিলিঙে তারকা প্রার্থী বাইচুং ভুটিয়া কে হারিয়েছিলেন। দুর্গাপুরেও অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এসেই জয়লাভ করেছিলেন। তার হারের রেকর্ড গত কয়েক বছরে নেই। যেখানেই তিনি দাঁড়ান, তিনি নাকি জিতে যান। কিন্তু অতীতের রেকর্ডে যদি দেখা যায় তাহলে ১৯৯৮ সালে এই আসানসোল লোকসভাতেই কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে গোহারা হেরেছিলেন এই সুরিন্দর সিং আলুয়ালিয়া। নিজেকে ভূমিপুত্র হিসেবে দাবি করলেও তার নিজের জন্মস্থান জেকে নগর নিয়েই তিনি নাকি কোনও খোঁজ খবরই রাখেন না বলে অভিযোগ। স্থানীয় কোনও সমস্যা সম্পর্কেও তার কোনও ধারনা নেই বলে অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা। অন্যদিকে দুর্গাপুরের সাংসদ থাকাকালীন তাকে দেখা যায়নি। তিনি কোনও কাজ করেননি বলেও দাবি করছে তৃণমূল। ফলে সেক্ষেত্রেও বাবুল সুপ্রিয়র মতন সহজে আসানসোলের বৈতরণী পার হওয়া সুরিন্দর সিং আলুয়ালিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। যদি বিধানসভা গত ভাবে পর্যালোচনা দেখা যায় তাহলে কুলটি বিধানসভায় যেখানে বিজেপি জয়ী হয়েছিল, সেখানকার বিধায়ক অজয় পোদ্দারের বিরুদ্ধে কুলটিবাসীর প্রচন্ড ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। এই লোকসভা ভোটে বিভিন্ন জায়গায় প্রচারে প্রার্থী সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়ার সামনেই স্থানীয় বাসিন্দারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন বিজেপি বিধায়কের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে আসানসোল দক্ষিণ কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল প্রার্থী হতে চলে গিয়েছেন মেদিনীপুরে। প্রশ্ন উঠছে তবে কি অগ্নিমিত্রা আসানসোল ছেড়ে পালাতে চাইছেন? সবে মিলে বিজেপিরও অবস্থা তথৈবচ আসানসোলে। দলের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও প্রকট। যদিও প্রচারের হাওয়াতে অনেকটাই এগিয়ে সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া। একদিকে মিঠুন চক্রবর্তী অন্যদিকে যোগি সহ হেভি ওয়েট নেতারা এসেছেন। আসছেন নরেন্দ্র মোদি সহ আরও একঝাঁক কেন্দ্রীয় নেতানেত্রী। শত্রুঘ্ন সিনহার প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়,অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এলেও প্রচারে তেমন ঝড় উঠছে না বলেই আসানসোল শহরে গুঞ্জন। অর্থাৎ এই আসনে সহজ জয় এবার কারোর পক্ষেই সম্ভব নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে সিপিএম প্রার্থী জাহানারা খান পরিবর্তনের সময়ও বাম দুর্গ জামুরিয়ায় বিধায়ক ছিলেন। অর্থাৎ বাম দুর্গ হিসেবে পরিচিত রানীগঞ্জ এবং জামুরিয়ার বামেদের ভোট পুনরায় বামেদের ঘরে আসছে এমনটাই মনে করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে জাহানারা খান জয়ী না হলেও বিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলির কাছে ভোট ভাগাভাগির ক্ষেত্রে একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবেন। কার ভোট তার ঘরে যায়, তার উপরেই নির্ভর করছে আসানসোলের জয়। আর তাই লড়াই হলেও সেটা কাঁটায় কাঁটায় হবে। তবে যেই জিতুক জয়ের ব্যবধান এবার বিরাট কিছু হবে না। গণতন্ত্রে অবশ্য সেটাই শ্রেয়।