Wednesday, September 17, 2025
Google search engine
Homeদক্ষিণবঙ্গ‘বিশ্বকর্মা’ প্রকৃতপক্ষে একটা পেশাগত পরিচয়

‘বিশ্বকর্মা’ প্রকৃতপক্ষে একটা পেশাগত পরিচয়

রণজিৎ গুহঃ বৈদিক জোতির্বিজ্ঞানের গণনার ভিত্তিতেই হিন্দু সমাজের দেবদেবীর পুজোপাঠ বা যাবতীয় উৎসব অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ সবই তিথি বা চান্দ্রদিন অনুযায়ী ঠিক করা হয়। ফলে বিভিন্ন দেবদেবীর পুজোর দিন একেক বছরে একেক দিন নির্ধারিত হয়। তিথি কিভাবে নির্ধারিত হয়? পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদ প্রায় সওয়া সাতাশ দিনে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে।অন্যদিকে এক অমাবস্যা থেকে আরেক অমাবস্যার সময়কাল প্রায় সাড়ে ২৯ দিন। এই সময়কালকে বলে চান্দ্রমাস। মোটামুটি একটি চান্দ্রমাসকে ৩০ দিয়ে ভাগ করে বৈদিক পঞ্জিকা অনুযায়ী, একটি চান্দ্র দিন ধরা হয়।এই চান্দ্রদিনকেই তিথি বলে। চাঁদ ও সূর্যের মধ্যে ১২ ডিগ্রি দ্রাঘিমাকোণ বৃদ্ধির সময়কে একটি তিথির সময়কাল ধরা হয়। তিথির সূচনার সময় দিন অনুযায়ী বদল হয় এবং তিথির মোট সময়কাল ১৯ ঘণ্টা থেকে ২৬ ঘণ্টার মধ্যে থাকে। একমাত্র ব্যতিক্রম বিশ্বকর্মা পুজো কিন্ত চান্দ্র তিথি অনুযায়ী হয় না। অন্যান্য পূজার দিনক্ষণ  চাঁদের  গতি-প্রকৃতির উপর নির্ধারিত হলেও বিশ্বকর্মার পূজার দিন সূর্যের গতি প্রকৃতির উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়। এই নিয়ম অনুসারে সূর্য যখন সিংহ রাশি থেকে কন্যা রাশিতে প্রবেশ করে তখন উত্তরায়ন শুরু হয়। এই সময়েই  দেবতারা  নিদ্রা থেকে জেগে ওঠেন এবং  বিশ্বকর্মার  পূজার আয়োজন শুরু করা হয়। হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী বিশ্বকর্মা পূজার দিনটি ‘কন্যা সংক্রান্তি’ বা ৩১ শে ভাদ্রতে পড়ে।  

মহাকাব্যর যুগ থেকেই বিশ্বকর্মাকে স্থাপত্য বিদ্যার ও অস্ত্র নির্মাণ এর দেবতা হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। পুরাণগাথা অনুযায়ী বিশ্বকর্মা কৃষ্ণের রাজধানী পবিত্র দ্বারকা শহরটি নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও তিনি রামায়ণে বর্ণিত লঙ্কা নগরী,  অলকা পুরী,পাণ্ডবদের মায়া সভা,রামায়ণে  উল্লিখিত পুষ্পক রথ,দেবতাদের বিভিন্ন গমনাগমনের জন্য বিভিন্ন বাহন,দেবপুরী এবং বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিব এর ত্রিশূল, কুবের এর অস্ত্র, ইন্দ্রের বজ্র, কার্তিকের শক্তি সহ দেবতাদের জন্য বহু কল্পিত অস্ত্রের স্রষ্টা।বৈদিক যুগে বিশ্বকর্মা স্থাপত্যবিদ্যা অস্ত্রনির্মাণ এবং দারু বা কাষ্ঠ শিল্পীর দেবতা হিসাবে অর্চিত হতেন।এমনকি কোনও কোনও পুরাণকার ব্রহ্মাণ্ড শ্রষ্টা বলেও উল্লেখ করেছেন। বোঝাই  যায় যে একজন ব্যক্তি বিশ্বকর্মা এত সব নির্মানে যুক্ত ছিলেন না। বিশ্বকর্মা প্রকৃতপক্ষে একটা পেশাগত পরিচয়।  অনেক পরবর্তিকালে বিশ্বকর্মা ক্রমশ বৈদিক আভিজাত্য হারিয়ে লৌকিক দেবতা হয়ে ওঠেন। পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথদেবের দারুমূর্তির শিল্পী হিসাবে সুখ্যাতির জোরেই প্রধানত কাঠের মিস্ত্রী বা সুত্রধরদের উপাস্য হয়ে ওঠেন। ক্রমে কর্মকার কুম্ভকার স্বর্ণকার ইত্যাদি সবধরণের মিস্তিরিদের মধ্যেই প্রভাব প্রতিপত্তি ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি মুদি ব্যবসাদাররাও বিশ্বকর্মাকে নিজেদের দেবতা মেনে নেন। বৈদিক যুগে বিশ্বকর্মা কল্পনায় দেবতাকে চার হাত ভাবলেও হাতে কি ধারণ করতেন তা স্পষ্ট জানা যায় না। বিশ্বকর্মার ধ্যান বা প্রণাম মন্ত্রে তা অনুল্লেখিত।

‘দেবশিল্পি মহাভাগ দেবানাং কার্য্যসাধক।

বিশ্বকর্মন্নমস্তুভ্যং সর্বাভীষ্টপ্রদয়ক।।’

লৌকিক চেহারায় বিশ্বকর্মার হাতে হাতুড়ী বাটালি দাঁড়িপাল্লা শোভা পায়। এই সময়ে প্রযুক্তি কল্যাণে বিপুলায়তন কলকারখানার শ্রমিক কর্মীরা যদিও হাতের কাজ জানা অসংগঠিত মিস্ত্রীদের সমগোত্রীয় মনে করেন না, কিন্তু আরাধ্য হিসাবে মিস্ত্রির দেবতা বিশ্বকর্মাকে মেনে নিয়েছেন। ইদানীং শুধু কায়িক শ্রমিকরা নয় মেধা শ্রমিকরাও সাড়ম্বরে বিশ্বকর্মা পুজোয় আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। ভাদ্র সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মা আরাধনা শ্রমশক্তির স্বীকৃতি ও সম্মাননা হিসাবেও দেখা যেতে পারে। শ্রমশক্তির প্রতিভু দেবতা বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটাকে বলা ভাল মিস্ত্রি দিবস। এক প্রাক্তন বিজলি মিস্তিরির তরফ থেকে সবধরনের সব মিস্ত্রিদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। কলকব্জা যন্ত্রপাতি হাত হাতিয়ার সচল রাখুন। নিজের ওপর ভরসা  রাখুন। আপনিই বিশ্বকর্মা। জগৎ স্রষ্টা। মিস্ত্রিদের নেতৃত্বেই এই গ্রহ সুন্দরতর হয়ে উঠবে। আপনার প্রতিনিধিত্ব আপনিই করুন। বাবুমশাইদের এড়িয়ে চলুন। আন্তর্জাতিক ভাবনায় ১ মে বিশ্ব শ্রমিক দিবস। ৮ ঘন্টার কর্মদিবসের সেই লড়াইয়ের আন্তরিক অংশীদারত্ব অবশ্যই স্বীকার করি। একইসাথে নিজস্ব দেশজ সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটি খেটে খাওয়া মানুষজনের নিজস্ব উৎসবের দিন হিসাবে পালিত হোক।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments