কথা নিউজ সার্ভিস
আসানসোল
হবেনা হবেনা করেও নজরুল মেলাটা শেষে হলো। শুরু থেকে শেষ যা হলো, এক কথায় তা মন্দের ভালো!
দেশ, বিদেশের শিল্পীরা গাইলেন, প্রায় আশানুরূপ লোক সমাগম হলো। কবিতায়, গানে ফের জেগে উঠল নজরুলের চুরুলিয়া। তবে, আক্ষেপ যেটা রয়ে গেলো, নজরুলের ভাষায় বললে, – ‘না মিটিতে আশা, ভাঙ্গিল খেলা।’
টানা দু’মাস ধরে বহমান ভোটপর্বের ধাক্কায় প্রায় চাপা পড়েই যাচ্ছিলেন বাঙালীর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অথচ, এটিই তাঁর ১২৫ তম আবির্ভাবের বছর। শেষ মেষ, নানা দোটানার পর আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় কবির জন্মভূমি চুরুলিয়ায় বহু কাঙ্খিত ‘নজরুল মেলা’র আয়োজন করল। স্বস্তি ফিরল চুরুলিয়ায়। এবারের পাঁচদিনের মেলাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে দ্বিতীয় বর্ষ হলেও, স্থানীয় নজরুল আকাদেমী এবং গ্রামবাসীদের উদ্যোগে চলে আসা নজরুল মেলার এটি আসলে ৪৪ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সমস্ত চুরুলিয়াবাসীর অন্তরাত্মা জুড়ে রয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। এবারো পাঁচ দিবসীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কবির স্মৃতি রোমন্থন করলাম আমরা। কবির বিশ্বায়িত চেতনার সাথে পুনরায় চুরুলিয়াবাসীর মেলবন্ধন মথিত হল।” তিনি জানান, “আগামী দিনে চুরুলিয়াকে কেন্দ্র করে রূপায়িত হতে চলেছে অনেক কর্মসূচী। যার মূল কান্ডারীই হবে বিশ্ববিদ্যালয়।”
কেন মন ভরলোনা চুরুলিয়ায় আসা নজরুল প্রেমীদের? বর্ধমানের মেমারি থেকে আসা সাহিত্যিক সুফি রফিকুল ইসলাম বলেন, “আগেও মেলায় এসেছি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের, বিশেষতঃ নজরুলের সঙ্গীত, সাহিত্য নিয়ে যেসব উচ্চমার্গের পরিবেশনা, আলোচনা হতো, এবার তার কিয়দংশও নজরে এলোনা। অথচ, এখন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এর আয়োজন, সেখানে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি।” একই কথা শান্তিনিকেতন থেকে আসা কবি পূর্ণানন্দ চক্রবর্তীর। তিনি বলেন, “বিদগ্ধজনের আলোচনা কই? আমাদের বিশ্বভারতীতে ছাত্রছাত্রীদের উচ্চমানের পরিবেশনা থাকে। সেসব কই? বুঝলাম, নজরুল চর্চার বিশেষ অবকাশ এখন না আছে চুরুলিয়ায়,না আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটা ভীষণই আফসোসের। এটা যেন স্রেফ চুরুলিয়া মেলা হয়ে গেছে।”
দক্ষিণবঙ্গের কবি, সাহিত্যিকদের এই আফসোসের বিশেষ কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদস্থরা। যেমন বললেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক চন্দন কোনার। তার কথায়, “মেলা কিন্ত সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হয়েছে। দেশ বিদেশের শিল্পীরা, নজরুল প্রেমীরা অংশ নিয়ে এবারের মেলাকে ভরিয়ে তুলেছেন।”
এবারের উৎসবে নজরুল ইসলামের প্রতি সঙ্গীতের মাধ্যমে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন বাংলাদেশের শিল্পী ফিরদৌস আরা, ভারতের ভজন সম্রাট অনুপ জলোটা, বাংলার শিল্পী মনোময় ভট্টাচার্য আর যন্ত্রসঙ্গীতে দাদুকে স্মরণ করেন কবির দৌহিত্র কাজী অরিন্দম। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল – মনোময় আবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীতগুরু যদুনাথ ভট্টাচার্য্যের দৌহিত্র। “এবারের উৎসব চুরুলিয়াকে মিলিয়ে দিল দুই দৌহিত্রের সঙ্গীত, বাদনের মূর্চ্ছনায়। সবাই দারুন খুশি,” বললেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল গবেষণা বিভাগের ডিরেক্টর সোমনাথ মুখোপাধ্যায়।
ওদিকে, মেলা চলাকালীন কবির সম্পর্কিত বৃহত্তর পরিবারের এক মহিলা সদস্য ও তার গুটিকয় সাঙ্গপাঙ্গ উৎসব প্রাঙ্গনে অশান্তির সৃষ্টি করার চেষ্টায় উদ্যত হলে, গ্রামবাসী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাধার মুখে তারা পিছু হঠতে বাধ্য হন।
স্থানীয় মানুষজনের একাংশ ক্ষোভের সাথে বলেন, “এতো বছর আকাদেমীকে সামনে রেখে অনেক কিছু করে নিয়েছে ওই সব তথাকথিত পারিবারিক কিছুজন। এখন সবকিছু সরকারি হস্তক্ষেপে চলে যাওয়ায় ওদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাই, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে গোলমালের চেষ্টা করেছে।” মেলায় আসা দোমোহানীর তারাপদ যশ বললেন, “এরা নজরুলের পরিবার বলে জমিদারি খাটিয়ে এসেছে এতকাল। এখন জবরদখল চলে যাচ্ছে বলে আর ধৈর্য্য রাখতে পারছেনা।” আসানসোলের সুকুমার ঘোষ কুড়ি বছর ধরে কবির জন্মদিনে চুরুলিয়ায় আসেন। ক্ষোভের সাথে বললেন, “কবির নিজের নাতি নাতনি যারা, তারাতো কখনও এমন করেননা, তাহলে এসব ডালপালাদের এতো দাপট কেনো?” কিছু সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের অবশ্য সঙ্গত ক্ষোভও রয়েছে। তাদের দাবি, “আমরা অবশ্য এটাও মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানের মানোন্নয়নের জন্য আরও সচেষ্ট হওয়া উচিৎ। নজরুল নিয়ে ওদের আরো সিরিয়াস হতে হবে, নইলে এসব অবাঞ্ছিত উটকো লোকের ঝামেলা বাড়বেই।” সোমনাথ বললেন, “এইতো সবে দুটি বছর হলো আমরা হাতে নিয়েছি। সামনে দীর্ঘ পথ। গ্রামের মানুষের পাশাপাশি দেশ বিদেশের গুণীজনের সহায়তা পেলে, শীঘ্রই শিখরে পৌঁছবে চুরুলিয়ার কবি স্মরণ, এব্যপারে আমরা ১০০ শতাংশ নিশ্চিৎ।”