কথা নিউজ সার্ভিস
————————————
দুর্গাপুরঃ শেষ হাসিটা এবার কি কীর্তি, সুকৃতির নাকি দিলীপের – প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে এপ্রিলের কাঠফাটা রোদ মাথায় ভোটে চলা বর্ধমান দুর্গাপুর কেন্দ্রে। ভোটের উত্তাপ ছাপিয়ে আগুন ঝরাচ্ছে সুর্য, হাঁপাচ্ছে মানুষ, তামার জমিনে ফুটছে রাঢ়ের মাটি,তেতে উঠেছে রাজনীতির পারদ – মুলুকের কব্জা কার হাতে তার সুলুক সন্ধানে!
ঝড়ের আগে যেন থমকে আছে মানুষ। মুখে রা নেই, তবে, ‘রায় ‘ বাঁধা আছে মনের সেতারে – বোঝাই যায়!
তৃণমূলের ব্যাটারি ঘর বলতে ভাতার, মন্তেশ্বর। বারে বারে সেখানে ছক্কা হাঁকিয়েছে ঘাসফুল, ২০২৪’র ভোটে কি সেই নিশ্চয়তা আদৌ আছে? ভাতারের বিধায়ক মানগোবিন্দ অধিকারীর লোকেরা কি প্রাক্তণ বিধায়ক বনমালী হাজরার মানভঞ্জন করতে পারলো? মন্তেশ্বরের সদগোপদের মনের তল পেলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’র দল? সেখানের সংখ্যালঘুরা কি ‘দিদির মমতায় সম্পৃক্ত?’
ভাতার, মন্তেশ্বরেই নয় – বর্ধমান (দক্ষিনে) কি ঘাসফুলের জয়??
এবার দেখাযাক,মাটি থেকে উঠে আসা বঞ্ছিত কিছু প্রশ্ন আর তার মোকাবিলায় টিএমসি, সিপিএম, বিজেপির প্রস্তুতিটা আসলে এখন ঠিক কোন পর্যায়ে!
# কীর্তি আজাদের চারপাশে যারা ঘুরছেন,তারা যে তৃণমূল কংগ্রেসকেই ভোট দেবেন বা লোককে ঘাসফুলের বোতামটাই টিপতে বলবেন, তার আদৌ কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?
# সুকৃতি ঘোষাল নিদেন ১.৬১ লক্ষ ‘বাঁধা ‘ ভোট কি এবারও পাবেন? প্রায় ১৫ লক্ষ ভোটারের বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা আসনে ২০১৯’র সিপিএম প্রার্থী আভাষ রায় চৌধুরী মোটে ১.৬১ লাখ ভোটই পেয়েছিলেন, যা ২০১৪’র সিপিএম প্রার্থী সইদুল হকের চেয়ে ২.৮৫ লক্ষ কম ভোট। পিঠে অগণিত ব্রুটাসের ছুরির দাগ নিয়ে এবারে ফের প্রচারে আসা আভাস শ্রেণী শত্রুর চেয়েও কি বেশি চিন্তিত ‘ঘরশত্রু ‘ বিভীষণ ‘ভাই ‘ দের নিয়ে? ২০১৪’র ভোটে বিজেপি প্রার্থী দেবশ্রী চৌধুরী ২.৩৭ লক্ষ ভোট পেলেও, ‘আকাশ থেকে আচমকা টপকে পড়া’ বিজেপি’র সুরিন্দর সিং আহলুওয়ালিয়ার ‘প্রেমে পাগল’ সিপিএম ওই ভোটকে একলাফে ৫.৯৮ লক্ষে নিয়ে যায় লোকলজ্জার মাথা খেয়ে। এবার কি তবে দিলীপ প্রেম?
# আদি বিজেপিরা হাতের নাগালে এবার তাদের ‘মহাগুরু’ দিলাপ ঘোষকে পেয়ে গেছে। অনেকে প্রকাশ্যেই বলছেন, “মোদী দাঁড়ালেও হয়ত ভোট দিতাম না। কিন্তু,দিলীপদা আমাদের ঘরের লোক, অভিভাবক। ওঁকে পেলে দলে ঢুকে পড়া এইসব বেনোজল গুলোকে এবার দূর করে দিয়ে গোবরজল লেপে দলকে শুদ্ধ করব।” নব্যরা কি তাহলে এবার প্রমাদ গুণছেন?
# এটা কি আদৌ কোনো জোট? নাকি নিজের নিজের ভাঙা কোমর নিয়ে আহ্লাদে আসল বিষয় থেকে মুখ ঘুরিয়ে পাশ ফিরে শোবার চেষ্টা কুঁজো বাম-কংগ্রেসের? রাষ্ট্রায়ত্ব কারখানাগুলির চৌহদ্দির বাইরে ‘নস্যি’ দু দলের এই নকল রাজনীতির খোলসে এখন লোকে হাসে আর বোঝে – এই ‘সঙেরা’ বাংলায় আসলে হল সঙ্ঘেরই দোসর – ইহা স্রেফ জনশ্রুতি।
তারা ভোটে নামে হয় ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ’ করতে, নয় স্থানীয় স্তরে দলের মোড়লদের শাঁসালো পার্টির সাথে গা ঘষাঘষি করে ‘নাম কে ওয়াস্তে’ দলের সাইনবোর্ড টুকু কোনওক্রমে টিকিয়ে রাখতে। কেউ কেউ আবার বলছেন, “কেন্দ্রের শাসক দলের ছুঁড়ে দেওয়া উচ্ছিষ্টের লোভে পার্টির পশ্চিম কেন্দ্রের কয়েকজন নেতা দলের কবর খুঁড়ে রোজদিন কার্ল মার্কস আর লেনিনের কফিনে মাটি চাপা দিচ্ছেন। গোপন বৈঠক করছেন বিজেপি নেতাদের সাথে আর সঙ্গে নিচ্ছেন তৃণমূল কংগ্রেসের জামা পরা ইয়ার দোস্ত কাউকে কাউকে”। সুকৃতি বললেন, “একথা বিশ্বাস করি না। কমিউনিস্টরা এমন কাজ করতে পারে না”।
# দিলীপ ঘোষের মতো ‘সাচ্চা সংঘে’র সৈনিক আদিদের সাথে ঘর করায় বরাবরই স্বচ্ছন্দ। নব্যদের থেকে সতর্ক দুরত্ব বজায় রাখছেন বটে, তবে, সিপিএম-তৃণমূল কংগ্রেসের জামা পরা দোআঁশলাদের এই ভোটের বাজারে আদতে তিনি কতটা বিশ্বাস করছেন? দিলীপ বলেন, “অনেকেই আসতে চায়। আমি সবাইকে আগেও নিয়ে নিয়েছি। এখন এলেও নিয়ে নেব। আপত্তি নেই”। তাহলে,যারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত শক্ত করেছিল, নিজের জমি পোক্ত করতে নির্বিচারে তাদের নিয়ে ঘর গোছাতে দিলীপের কোনো আপত্তি নেই! প্রশ্ন- দিলীপের এই উদারতা কেন? উত্তর- তৃণমূল কংগ্রেসের প্রায় দিনের আভ্যন্তরীন ভোট মিটিং-র ‘গোপন তথ্য দিলীপের রোজদিনকার ‘মর্ণিং ওয়াক শো’র আগেই তার প্রাতঃরাশের টেবিলে অনায়াসে পৌঁছে দিচ্ছেন দুর্গাপুর, বর্ধমানের তৃণমূলেরই কিছু কেষ্ট বিষ্টু এবং হাফ নেতা। উদ্দেশ্য? – কেউ চান উড়ে আসা কীর্তির চিরবিদায়। কেউ দিলীপ ‘ভক্ত’, আর কেউ কেউ কেন্দ্রীয় এজেন্সির ভয়ে কাঁটা! তাই ভাবছেন – ‘এভাবে সেবা করে খুশি রাখলে,দিলীপ যদি পরে বাঁচিয়ে দেন’! এদের বাইরেও আরেকটা টাইপ আছেন – যারা এই ভোটে দিলীপ ঘোষের ‘উপকার করে’ আসলে রাজনীতির ময়দানে ‘বধ’ করতে চান রাজ্যের মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারকে। তাদের ধারনা- দিলীপকে ভোটে ধরাশায়ী করতে পারলে আসল ‘ট্রফি’টা উঠবে দুর্গাপুর (পূর্ব)-র বিধায়ক প্রদীপ মজুমদারের হাতে। আর বর্ষিয়ান প্রদীপ কি ভাবছেন? তার কথায়, “আমাদের সবার ইচ্ছা, স্বপ্ন আর শ্রমের লক্ষ্য একটাই – বিজয় ট্রফিটা উঠবে আমাদের অলরাউন্ডার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই হাতে।”
# বর্ধমান-দুর্গাপুরে এবার কি প্রদীপের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে? নাকি তার দলের চেষ্টায় কীর্তিই হবেন আসল কীর্তিমান? “বলা ভীষণ শক্ত। দিলীপের জনপ্রিয়তার চেয়েও এই আসনে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তৃণমূল কংগ্রেসের আভ্যন্তরীন গদ্দারি, ফিকে হয়ে যাওয়া লাল পতাকার গেরুয়া গড়ন আর খোদ কীর্তি আজাদের নিজেকে আরো মেলে ধরা মানুষ তথা দলের কর্মীদের কাছে, না হলে ওনার কোনো চান্সই নেই”, দাবি দুর্গাপুরের একটি সরকারী মহাবিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপকের। তার মতে, “এই সব দক্ষিণপন্থী দলগুলির খোলা বারান্দা থেকে সবসময় দক্ষিণা বাতাস বয়ে আসে আর তাতে ভেসে আসে ওদের সব হাঁড়ির খবরাখবর। সবাই সব জেনে যায়, কারন অল্পেতেই এরা সব বলে দেয়, তার ওপর আছে ইদানিংকার ‘হোয়াটস অ্যাপ কলে’র বাড়িত মজা। যা খুশি কথা পাচার করো- কোনো প্রমান নেই!”
# “আপনি আজাদ। আপনি কি মুসলমান?” – গত বৃহস্পতিবার বিকেলের চা-চক্রে হঠাৎ প্রশ্ন কাঁকসার গোপালপুর পঞ্চায়েত এলাকার এক তৃণমূল সমর্থকের। প্রশ্ন শুনে চোখ কপালে কীর্তির। স্বাত্বিক ব্রাক্ষ্মণ তিনি, মাথার পিছনে লম্বা টিকি – আর মৈথিলি এই বামুনকেই বলে কিনা মোছলমান!!
দেশের হয়ে ১৯৮৩’র বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ট্রফি জিতে আনা খেলোয়াড়, যিনি একমাস ধরে বর্ধমান-দুর্গাপুরের হাটেমাঠে ঘুরছেন, তাকে নিয়ে এখনো এমন অবান্তর প্রশ্ন বাড়ছে কিনা দলের লোকের মনেই? না। আসলে, কারো একার নয়, এই প্রশ্ন ফুটছে বহু উদ্বাস্তু কলোনির লোকের মনেই। বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভাগবৎ ঝা আজাদের পুত্র কীর্তি দু’দুবারের বিজেপির সাংসদ ছিলেন, তাও, প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার নামের এই ‘আজাদ’ লেজুড়কে নিয়ে দেদার মার্কেটিং করেছে গ্রামীণ বিজেপির একাংশ। ‘আজাদ হিন্দ ফৌজে’র প্রাণপুরুষের মাটিতে এসে তার নামের সাথে জুড়ে থাকা গর্বের ‘আজাদ’টাই কিনা শেষে তার যন্ত্রনার কারন! অথচ,এই আসনেই ২০১৪ তে জেতা তৃণমূলেরই মমতাজ সংঘমিতা মুসলমান পরিবারের হলেও, তাকে কেউ এমন প্রশ্ন করেনি। তবে এটা কি জাস্ট ‘দিলীপ এফেক্ট’? আরো প্রশ্ন – এমন সওয়ালে কি তবে “অ্যাডভান্টেজ দিলীপ?” মেরুকরণের সাফল্য? ভাতার যাওয়ার পথে ঈদের নামাজের পর মুসলমানদের সাথে দিলীপের হঠাৎ মেশা, তারপর আবার তারই মুখে- “ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মুসলিমদের ভোটের স্বার্থে এতোদিন যে ব্যবহার করে এসেছে, এবার আর তা হবে না”- এমন দাবির পরও কি ‘মুসলিম তোষণে’র অন্যতম অভিযোগকারী দিলীপও আজাদকে মুসলমান বলে চালানোয় খুশি? না। সঙ্ঘের শিক্ষায় দিক্ষিত দিলীপ ভালো করেই জানেন – ‘লোক দেখানো’ হলেও,সঙ্ঘের নিজেরই তো সংখ্যালঘু সেল রয়েছে,তাই বেশি মুসলমান মুসলমান করলে তার দলের অন্দরেই রোষ যাচ্ছেতাই বেড়ে যাবে একাংশের।
# খোকন দাসের গঢ়ে কি এবার পদ্ম চাষ বেশি হচ্ছে? তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব’র কাছে এমন রিপোর্ট যাওয়ার পর বেশ অস্বস্তিতে জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। গত ২০১৯ এ খোকনের বর্ধমান (দক্ষিণ) বিধানসভা এলাকায় মমতাজ জেতেন মাত্র ১৩৩৮ ভোটে। সেখানে সিপিএমের ভোট ছিল ১৮৮৪৮ আর কংগ্রেসের ভোট ছিল ৪৬১৬টি। এই কেন্দ্রের ভোটার ২.৫৮ লক্ষ। গত ২০২১’র ভোটে ওই কেন্দ্রে খোকন জেতেন ২১ হাজার ৮৬ ভোটে। ওখানে ২০২১ এ সিপিএমের ভোট বেড়ে ২৩ হাজার ৩৪৬ হয়। কিন্তু তারপর? “ ক্ষয় হয়েছে ভালো মতনই,কারণ কিন্তু খোকন দাস নিজেই”, বলে দাবি স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের একাংশের। তাদের যুক্তি, “মুকুল রায়ের একদা ঘনিষ্ঠ খোকন সবসময় দু’নৌকোয় পা রেখে চলেন। ওনার কাজকর্মে তৃণমূলেরই বহু মানুষ বিরক্ত।”
এবার আবার সেই মৌলিক প্রশ্ন- কীর্তির চার পাশে ঘোরা তার দলের লোকেরাই কি কীর্তিকে ভোট দেবেন? দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার ঠিকা শ্রমিক সংগঠনের হাফ নেতা টু ফুলনেতা দিব্যি করে বলছেন বটে- তারা নাকি ‘দিদির সৈনিক’! ভালো কথা। তাদের কেউ কেউ কি সুকৌশলে দিলীপ ঘোষের আস্তিন থেকে বেরিয়ে এসে ঘাসফুলের বনে মনের সুখে বিন বাজাচ্ছেন? জেলা তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সপাটে প্রশ্ন অথবা জবাব নাকি কৈফিয়ৎ, “একটা নাম বলুন। ওসব হাওয়ায় আন্দাজ করে কোনো লাভ নেই। স্পেসিফিক বলতে হবে।”
হ্যাঁ। এটা কিন্তু, চলতি হাওয়ারই কথা। এর ঠোস্ প্রমান এখনো তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে নেই ঠিকই, তবে, বিজেপির কিছু লোকের পকেটে সে প্রমাণ দিব্য রয়েছে, বলে তাদের দাবি।
তা হলে? শিয়রে সঙ্কট নিয়ে জেলা চষে ফেলা নরেন নিজেও বুঝছেন – আসানসোল থেকেই হয়তো ভারি গীয়ার দেওয়া হচ্ছে দুর্গাপুরের গাড়ীতে এমন ভাবেই – যাতে গাড়ির চাকায় ব্রেক না পড়ে, কিন্তু,গতি হবে ধীরে,আরো ধীরে। তাতে কার লাভ? সূত্রের জবাব- ‘লাভ দিলীপ ঘোষের হলে, আসানসোলেরও লাভ আর বসে বসে আঙুল চুষবে দুর্গাপুরের ঘাসফুল!!’