নিজস্ব প্রতিনিধি,বাঁকুড়া,৮ অক্টোবরঃ সকালে সবেমাত্র সূর্য উঁকি দিয়েছে পুব আকাশে। মুর্ছা পাহাড় থেকে মুহুর্মুহু গর্জে উঠলো কামান। ঢাক ঢোল আর সানাই এর মিলিত নহবতের শব্দে মল্ল কূলদেবী মৃন্ময়ীর মন্দিরে পা রাখলেন বড় ঠাকরুন অর্থাৎ মহাকালী। ১০২৭ বছরের প্রাচীন রীতি মেনে পুজো শুরুর বারো দিন আগেই বিষ্ণুপুরের মল্ল কূলদেবীর মন্দিরে মহা সমারোহে শুরু হয়ে গেল দুর্গাপুজা। কামানের গর্জন মল্লভূম গড়ে ঘোষণা করল আগমনীর আগমন বার্তা। এ রাজ্যের প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজ কূলদেবী মৃন্ময়ীর পুজো। চলতি বছর এবার পা রাখল ১০২৭ বছরে। জানা যায় একসময় মল্ল রাজাদের রাজধানী ছিল জয়পুর ব্লকের প্রদ্যুম্নপুর গড়ে। ৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দের কোনো একসময় তৎকালীন মল্ল রাজা জগৎমল্ল শিকারে বেরিয়ে পৌঁছে যান তৎকালীন ঘন জঙ্গলে ঢাকা বিষ্ণুপুরে। একটি বট গাছের ছায়ায় ক্লান্ত ও অবসন্ন জগৎমল্ল ঘুমিয়ে পড়েন। এই সময় বিভিন্ন অলৌকিক কর্মকান্ডের সাক্ষী হন তিনি। কথিত আছে এই সময়েই দেবী মৃন্ময়ী রাজার সামনে আবির্ভূত হয়ে বট গাছের পাশে দেবী মন্দির প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি রাজধানী প্রদ্যুম্নপুর থেকে বিষ্ণুপুরে স্থানান্তরের নির্দেশও দেন দেবী। সেই নির্দেশ মোতাবেক রাজা জগৎমল্ল জঙ্গল কেটে বিষ্ণুপুরের সেই স্থানেই প্রতিষ্ঠা করেন মৃন্ময়ীর সুদৃশ্য বিশাল মন্দির। পাশেই তৈরী হয় বিশাল রাজপ্রাসাদ। প্রদ্যুম্নপুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনা হয় বিষ্ণুপুরে। রাজ কূলদেবী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত মৃন্ময়ীর মন্দিরে শুরু হয় দুর্গাপুজা। প্রথমে কয়েকবছর ঘটেপটে পুজা হলেও পরে গঙ্গামাটি দিয়ে দেবীমুর্তি তৈরী করে মন্দিরে শুরু হয় পুজো। রাজার পুজো। স্বাভাবিক ভাবেই সেই পুজোয় ছাপ পড়ে রাজ আভিজাত্যের। একসময় মল্ল রাজারা শাক্ত থাকায় দেবীর পুজো হত তন্ত্র মতে। হত নরবলিও। ষোড়শ শতকে রাজা বীর হাম্বির শ্রীনিবাস আচার্যর সান্নিধ্যে এসে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহন করে বৈষ্ণব ধর্মকে মল্ল রাজত্বে রাজ ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই নরবলি বন্ধ হয়ে সঙ্গীতের অষ্টরাগে দেবী আরাধনা শুরু হয়। রাজ বাড়ির নিজস্ব বলী নারায়নী পুঁথি অনুসারে দেবীর পুজো হয়ে আসছে গোড়া থেকেই। স্বাভাবিক ভাবেই এই পুজোর নিয়ম কানুন সবই আলাদা। জীতাষ্টমীর পরের দিন নবমী তিথিতে এখানে স্থানীয় গোপাল সায়ের নামের একটি পুকুরে বড় ঠাকুরানি অর্থাৎ মহাকালীর পটে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে ঘটা করে তা আনা হয় মৃন্ময়ীর মন্দিরে। এরপর মান চতুর্থীর দিন মন্দিরে আনা হয় মেজ ঠাকুরানি ও সপ্তমীর দিন মন্দিরে আনা হয় ছোট ঠাকুরানিকে। রীতি মেনে আজ সকালে বড় ঠাকুরানিকে স্থানীয় গোপাল সায়ের থেকে মৃন্ময়ী মন্দিরে আনার মধ্য দিয়ে মল্লভূম জুড়ে সূচিত হয়ে গেল দুর্গাপুজা। স্থানীয় মুর্ছা পাহাড় থেকে মুহুর্মুহু কামানের শব্দে কেঁপে উঠল গোটা মল্লভূম। একসময় মৃন্ময়ীর পুজোকে ঘিরে যে জেল্লা জমক ছিল রাজন্যপ্রথা বিলোপের পর তা আজ অনেকটাই ম্লান। কিন্তু আজো কৃষ্ণা নবমী তিথিতে মুর্ছা পাহাড় থেকে তোপধ্বনি হলেই পুজোর বোধনের আগেই পূজা উদযাপনে মেতে ওঠেন আপামর মল্লভূমবাসী।
মুহুর্মুহু গর্জে উঠল কামান,পুজোর বারো দিন আগেই মন্দিরে পা দিলেন মল্লরাজ কূলদেবী মৃন্ময়ী
RELATED ARTICLES