সাথী প্রামানিক,পুরুলিয়া,৭ জুলাইঃ রথযাত্রা উপলক্ষ্যে উৎসবের আমেজ দেখা গিয়েছে পুরুলিয়ায়। জেলা জুড়ে জগন্নাথ বলরাম শুভদ্রার রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হল। শত বর্ষ প্রাচীন মনি বাঈজীর রথ চলল পুরুলিয়ার রাস্তায়। উৎসবের আমেজে রথের দড়ি টানার সুযোগ পান পুণ্যার্থীরা। ১৯১২ সালে এক বাঈজীর সূচনা করা রথ আজও সমান মর্যাদায় ঐতিহাসিক রথযাত্রা উত্সব পালিত হয় পুরুলিয়ায়। পঞ্চকোট রাজাদের আমলে লখনৌ থেকে মুন্নি বাঈ বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে বৈষ্ণবীর জীবন যাপনে অভ্যস্ত হন। পরে মনমোহিনী বৈষ্ণবী নামে খ্যাত হন তিনি। ১৮৯৮ সালে পুরুলিয়া শহরের প্রাণ কেন্দ্র চকবাজারে একটি মন্দির নির্মাণ করেন তিনি। সেখানে শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দ জীউর বিগ্রহ অধিষ্ঠিত করিয়ে রথ যাত্রা সূচনা করেন। নানান দেব দেবীর মূর্তি ও কারু-কার্যে ভরা পিতলের রথটি এক দারুণ শিল্প শৈলীর নিদর্শন হয়ে দেখা দেয়। নির্মাণকালে রথটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ১২ ফুট এবং উচ্চত প্রায় ২২ ফুট ছিল। কিন্তু; পরে রথ যাত্রার নির্দিষ্ট (পোষ্ট অফিস মোড় থেকে রথ তলা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার) পথের দু’পাশে দোকান ও পাকা ঘর নির্মাণের ফলে,রাস্তা সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়। সেই কারণে রথটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতার সংস্কার করা হয়। চার দিকে দু ফুট করে কমানো হয়। দশ চাকার পরিবর্তে আট চাকা লাগানো হয়। রাধা গোবিন্দ জীউর দৈনন্দিন সেবা পূজা ও রথযাত্রা উত্সব সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য মনি বাঈজী পুরুলিয়া শহরের তত্কালীন কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিগণকে নিয়ে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন। সেই বোর্ডের অন্যতম এক্সিকিউটর চকবাজারের বাসিন্দা নন্দলাল দত্ত কয়ালের পরিবার বংশানুক্রমে ১৯২২ সাল থেকে সেই দায়িত্ব পালন করে আসছেন । সূচনাকালে রথ যাত্রা উত্সব হরি নাম সংকীর্তন এবং নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র সহযোগে কুড়ি জন কুলির টানে সূর্যাস্তের আগেই শেষ হয়ে যেত। ১৯৬৩ সাল থেকে গ্যাস বাতির আলোকমালায় সু-সজ্জিত রথটি সন্ধের পর যাত্রা শুরু করা হয়। ঠিক তার আট বছর পর আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। বৈদ্যুতিক আলোয় সাজানো হয় রথটিকে। রথের দিন নানা দুর্ঘটনা এড়াতে ২০০০ সালে রথটির নক্সা পরিবর্তন করা হয়। রথ টানার জন্য কুলিদের সঙ্গে সঙ্গে ট্রাক্টরের সাহায্যে রথ চালিত করা হচ্ছে। অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল কৃষ্ণ-বলরাম-সুভদ্রা নন, এই রথে রাধা-গোবিন্দ-ই অন্যতম দেবতা – যাঁরা রথে থাকেন। প্রশাসনের সহযোগিতায় সুশৃঙ্খলভাবে রথের দিনে ধর্মপ্রাণ ও উত্সব প্রিয় মানুষ জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে মিলে মিশে একাকার হয়ে যান। কালের গতিতে সংস্কৃতির পরিবর্তন হলেও ট্রাক্টর চালিত বাঈজীর প্রতিষ্ঠিত রথেই মেতে উঠেন পুরুলিয়াবাসী। পুরুলিয়ার সরবাগানের জগন্নাথ দেবের মন্দির থেকে রথযাত্রা হয়। ২০১৪ সাল থেকে গোপালমোড় সরবাগানে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির প্রতিষ্ঠা বছর থেকেই জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রা ও রথ যাত্রা এই দুটি উৎসব মহা ধূমধামের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। অগণিত মানুষের সমাগম হয়। তেলকল পাড়া হয়ে ওভারব্রীজ রাঘবপুর মোড় পৌঁছায় রথটি। শেষে সাহেব বাঁধের কাছে সূর্য মন্দিরে যাত্রা শেষ হয়। পুরুলিয়া শহরে দুলমী, শরৎ সেন কম্পাউন্ড থেকে দুটি আলাদা রথ বের হয়। এছাড়া বলরামপুরে, জয়পুর, বাঘমুন্ডি, ঝালদা, মানবাজার মহকুমা, রঘুনাথপুর সদর সহ মহকুমায় সব ব্লকেই একাধিক রথ বের হয়। জেলার কুড়িটি ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে রথযাত্রা উপলক্ষ্যে মেলা বসে।
১৯১২ সালে এক বাঈজীর সূচনা করা রথ আজও সমান মর্যাদায় পালিত হয় পুরুলিয়ায়
RELATED ARTICLES