সনাতন গরাঁই,দুর্গাপুর: জগন্নাথের মাসীর বাড়িতে বকরী-ঈদে’র নমাজ! এও কোথাও হয় নাকি? আর কোথাও না হলেও শস্যশ্যামলা বাঙলায় হয়,বিশেষ করে যে বাংলায় শহর দুর্গাপুরের মতো জনপদে পাশাপাশি থাকে হিন্দু মুসলমান,যে বাঙলার মেমারীর দুর্গাপূজো কমিটির সচিব হন গোলাম রসুল!
সোমবারের সকাল। আজানের ধ্বনি শোনা গেল শহরের ইস্পাত নগরীতে, জগন্নাথের রথ যাত্রার প্যান্ডেলে। আজকে ঈদুজ্জোহা। আল্লাহ্’র উদ্দেশ্যে উৎসর্গের দিন। তারই নমাজ। আজানের মাধ্যমে সেই নমাজে সামিল হওয়ার আওহান। শহরবাসীর একটুও ভ্রু কোঁচকালো না,যখন ওই প্যান্ডেলের নিচেই শুরু হয়ে গেল ঈদুজ্জোহার নমাজ। বাইরে থেকে রথযাত্রার প্যান্ডেল বাঁধার কাজে আসা মজুরেরা অবশ্য গোড়ায় ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারেনি – হচ্ছেটা কি,এ যে ঘোর কলি!
শহরে প্রতিবারের মতো রথযাত্রার আয়োজন শুরু হয়েছে। তারই প্রস্তুতি প্যান্ডেলের নিচে এদিন হলো ইদুজ্জোহা’র গুরুত্বপূর্ন দু’রাকাত নমাজ। আর তার সাথেই দুই সম্প্রদায়ের মিলন মেলায় ভাসলো শিল্পশহর দুর্গাপুর।
কয়েকদিন ধরেই চলছে ইস্কনের এই রথের মেলার প্রস্তুতি। তারই মাঝে,সেই মেলার মাঠেই এই বিশেষ দিনে কাতারে কাতারে নমাজ পড়তে দেখা গেল শহরের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের। আসলে,ওই মাঠে বাঁশের কাঠামোয় ত্রিপল টেনে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করলেন ইস্কন কর্তৃপক্ষই। বৃষ্টি ভেজা এদিনের সকালে ইস্কনের তৈরি প্যান্ডেলেরই নিচে নমাজের শেষে কোলাকুলির আলিঙ্গনে এদিন যেন মিলেমিশে একাকার রথযাত্রার আর ইদুজ্জোহার আয়োজকদের হৃদয়।
নমাজের আয়োজক কমিটি এদিন ধন্যবাদ জানালেন ইস্কন কর্তৃপক্ষকে। এই নমাজের এমন ছবি একেবারেই হয়তো ব্যতিক্রমী দেশের অন্য কোথাও,বলে মনে করছেন শিল্পাঞ্চলের মানুষ। জুলাই মাসের ৭ তারিখ রথযাত্রা। তার আগেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে তারই প্রস্তুতি। দু’বছর হলো দুর্গাপুরের ইস্কনের রথের মেলাটি বসে ইস্পাতনগরীর আকবর রোড ময়দানে। চলে টানা সাতদিন অব্দি। হপ্তাভ’র ধরে চলে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার বিচার,অনুষ্ঠান। তার আয়োজনেই চলছে বাঁশের কাঠামো করে প্যান্ডেল তৈরির কাজ।
দুর্গাপুরের আকবর রোডের ঈদগা কমিটি বরাবরই ঈদ,বকরী-ঈদের নমাজ পাঠের আয়োজন করে ওই মাঠেই। এবার ইস্কনের প্যান্ডেলের কাজ চলছে। তাতে কি? সোৎসাহে ওই নির্মীয়মান প্যান্ডেলেই নমাজ পড়ার ব্যাবস্থা করলেন ইস্কনের প্রধান সেবায়েত ওধ্যাজ্যচন্দ্র দাস। আকাশে মেঘ দেখে টাঙ্গিয়ে দিলেন বাড়তি ত্রিপল। মাটিতে বিছিয়ে দেওয়া হলো চাদর,শতরঞ্জি। যাতে নামাজ পাঠে বিঘ্ন না ঘটে। আকবর রোড ঈদগা কমিটির পক্ষ থেকে হারুন আল রসিদ বলেন,”আজ ঈদের অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে হয়েছে। এর পিছনে ছিল দুর্গাপুরের ইস্কন কর্তৃপক্ষ। উনারা আমাদের নমাজ পড়ার জায়গাটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেছিলেন। ওপরে ছাউনির ব্যবস্থা করেছিলেন। সকালে বৃষ্টিও হয়েছিল কিন্তু নামাজ পড়তে কোন সমস্যাই হয়নি। উনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। একইরকম ভাবে রথের উৎসবেও আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে বরাবরের মতো।” ইস্কনের প্রধান সেবায়েত ওধ্যাজ্যচন্দ্র দাস বলেন,”জগতের নাথ জগন্নাথ সবার। আমরা বিশ্বাস করি – জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানব জীবনে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকায়।” তিনি বলেন, রথের আগেই বকরি ঈদের নামাজ পড়ার জন্য এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা আমাকে জানান। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতি প্রকাশ করি। স্ট্রাকচার তৈরি করে ত্রিপল টাঙিয়ে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তোলা হয় আজকের নামাজের জন্য। আজ সকালে বৃষ্টিও হয়েছিল। কিন্তু ওই প্যান্ডেলের নিচে নামাজ পড়তে কোনো সমস্যাই হয়। উনারাও খুব খুশি। আমরা এভাবেই সকলে মিলেমিশে থাকতে চাই।”