Wednesday, November 27, 2024
Google search engine
Homeদক্ষিণবঙ্গঘরছাড়াদের ‘আপন আলয়’ অন্ডাল পরিবার

ঘরছাড়াদের ‘আপন আলয়’ অন্ডাল পরিবার

প্রণয় রায়,দুর্গাপুরঃ অনেক দিন পর অন্ডাল পরিবার এলাম।২০১৬ সালে এসেছিলাম। দামোদর নদের  পার ঘেঁষে অন্ডাল গ্রাম পঞ্চায়েতের গৃহহীন মানুষদের জন্য বানানো কয়েকটি পরিত্যক্ত ঘর। সেই ঘরগুলোতে জন্ম নিল অন্ডাল স্টেশনে  ভিক্ষা করা কিছু অনাথ শিশুদের নিয়ে এক শিশু আবাস অন্ডাল পরিবার। শুরুতে ষোল জন শিশুদের নিয়ে শুরু হয় অন্ডাল পরিবার। প্রথমে  অন্ডাল স্টেশনের একটি পরিত্যক্ত  ঘরে কয়েকজন সমাজসেবী ওদের সমাজের মূল স্রোতে আনতে পড়াশুনা শুরু করান। নিজেরা চাঁদা দিয়ে তাদের দুপুরের খাবার জোগাড় করতেন। এরপর মানবিকভাবে এগিয়ে আসে অন্ডাল পঞ্চায়েত। সঞ্জয় সিনহা (চাপাল), নরেন ঘোষ, গৌতম দাস,মালতী মন্ডল সহ আরও অনেকের সহযোগিতায় গড়ে ওঠে অন্ডাল পরিবার। স্টেশনে ভিক্ষাবৃত্তি,ট্রেনে ঝাঁট দেওয়া ইত্যাদি কাজ করে ক্ষুন্নিবৃত্তি  করা ও স্টেশন চত্তরে রাত বিরেতে পড়ে থাকা শিশুগুলি মাথার ওপর একটা ছাদ পেল। দুবেলা আহার,জামাকাপড়,পড়াশুনা করে স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পেয়ে শিশু ও কিশোরগুলোর মানুষ হবার স্বপ্ন সফল হলো। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হবার সময় অনাথ এই ছেলেমেয়েগুলোর  লোকাল গার্জিয়ান বা স্থানীয় অভিভাবকের প্রয়োজন হল। এগিয়ে এলেন সঞ্জয়  সিনহা যিনি চাপাল নামে পরিচিত। সেই থেকে বছর  পঞ্চাশের  এই অকৃতদার মানুষটির ঘর সংসার সব কিছু এই অন্ডাল পরিবার। প্রায় আট বছর ধরে চলছে এই অন্ডাল  পরিবার। সেদিনের ষোল জন শিশুদের আজ সবাই কিশোর। কয়েকজন এই আবাসিক ছেড়ে চলে গেলেও পুরানো অনেকেই রয়েছে। যেমন রাজা। কি ভদ্র ও বিনয়ী ছেলে। এখন ক্লাস এইটে পড়ছে। ওর মত আরও পুরানো কয়েকজন নতুন আবাসিক শিশুদের দেখভালও করে। এখন মোট সাতাশ জন শিশু কিশোর আবাসিক। এদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করলাম। ওরা সবাই সমস্বরে বললো ওরা এখানে খুব ভালো আছে। সঞ্জয় সিনহা বলছিলেন করোনার সময় করোনায় আক্রান্ত মানুষদের জন্য সেবামূলক কাজে জন্ম নিয়েছে অ্যামিস স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। যা আজ অন্ডাল  ও অন্ডাল সংলগ্ন কয়লা শহর ও দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের মানুষের বিপদে আপদে বড় ভরসা। রক্তের প্রয়োজন সহ বিভিন্ন আপদে বিপদে ‘অ্যামিস’ নিরন্তর কাজ করে চলেছে। সঞ্জয় আলাপ করাল একজন বিশেষভাবে মানসিক ও শারীরিক  দিক থেকে  সক্ষম মেয়ের সাথে। সঞ্জয় জানায়, ও কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। কথা বলতে বা কিছু শুনতে অক্ষম। কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে সব বোঝে। ওকে অন্ডাল স্টেশনে পেয়েছিল। অল্পবয়সী মেয়ে। কি সুন্দর  রঙিন শাড়ী পরে শাঁখা সিন্দুর ও সোনার জলের ঝুটা গয়নায় সজ্জিত হয়ে হাসিমুখে আকারে ইঙ্গিতে জানাল- ও এখানে খুব ভাল আছে। এটাই ওর বাড়ি। সঞ্জয়  বলল, ও  লেখাপড়া না জানায় কথা বলতে না পারায় ওর সম্পর্কে  কিছু জানা যায় নি। প্রশাসনকে ওর বিষয়ে জানানো হয়েছে।  অকৃতদার সঞ্জয় ছলছলে চোখে বলে ও আমাকে ওর বাবার মত দেখে। এর পর হেসে বলল, আসুন আর একটা মেয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দিই। একদিন সংসারে ভুল বোঝাবুঝি করে স্বামী সংসার ছেড়ে মেন্টাল ডিপ্রেশনে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। ওর বাপের বাড়ি এই কযলা খনি অঞ্চলেই। উদ্ভ্রান্তের মত অন্ডাল স্টেশনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অন্ডাল স্টেশনের স্টাফেরা ওকে পুলিশের হেপাজতে রেখে ‘অ্যামিস’ ও ‘অন্ডাল পরিবারে’র সঞ্জয়কে খবর দেয়। কারণ, এর আগেও এ ধরণের অনেক ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা মানুষকে অন্ডাল পরিবার আশ্রয় দিয়েছে ও প্রশাসনের সাহায্যে অনেকের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই মেয়েটির ক্ষেত্রেও  ‘অ্যামিস’ ও অন্ডাল পরিবার এগিয়ে এসে তাঁকে আশ্রয় দিয়ে ছিল। অ্যামিসের সদস্যরা প্রশাসনের সহায়তায় কলকাতায় ওর স্বামীর সাথে যোগাযোগ করে এবং তার স্বামী অন্ডাল পরিবারে আসে। সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গিয়ে মেয়েটিকে তার স্বামী কলকাতা নিয়ে চলে যায়। সঞ্জয় ও অন্ডাল পরিবারের কাছে মেয়েটি চির কৃতজ্ঞ। রবিবার অন্ডাল পরিবারের রক্তদান শিবির,পান্তাভাত উৎসবে সে ওর ছেলেকে নিয়ে যোগ দিতে এসেছিল। রক্তদান শিবিরে রক্তও দেয়। আসানসোল জেলা সরকারী হাসপাতালের সুপার নিখিল চন্দ্র দাস সেই করোনার সময় থেকে ‘অ্যামিস’ ও অন্ডাল পরিবারের নানান সমাজসেবামূলক কাজে  সহায়তা করে চলেছেন। যে কোন ধরণের বিপদগ্রস্থ রোগীকে অ্যামিস এর সদস্যরা আসানসোল হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা তিনি করেন। এই রক্তদান শিবিরের তিনি প্রশংসা করে বলেন, এই প্রচন্ড গরমে হাসপাতালগুলিতে প্রচন্ডরকম রক্তের অভাবে রোগীদের চিকিৎসায় সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।  তিনি অ্যামিসকে একটি দায়িত্ব দিয়ে বলেন, প্রচন্ডভাবে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের  সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। অথচ অনেকে তা জানতেই পারেন না। এই রোগের ধারক ও বাহকদের রক্তপরীক্ষার জন্য অ্যামিস কে এই এলাকার স্কুল কলেজ গুলিতে ছাত্রছাত্রীদের রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আসানসোল মহকুমা হাসপাতাল এ বিষয়ে তাদের সব সাহায্য করবে।  দামোদরের কাছে নির্জন অনাথ আশ্রম অন্ডাল পরিবার কিন্তু রবিবারের অনুষ্ঠান ঘিরে বেশ জমজমাট ছিল। একদিকে স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির অন্যদিকে পরিবারের স্থায়ী মঞ্চে শিল্পীর কন্ঠে উদাত্ত রবীন্দ্র সঙ্গীত,গ্রামের মেয়েদের ঝুমুর নাচ। বেশ লাগল পান্তা ভাত উৎসব। পান্তাভাত,আলু সিদ্ধমাখা,আলু পোস্ত,ডালের বড়া ও মাছের টক দিয়ে হল রাতের ভোজন। একদিকে অন্ডাল পরিবারের শিশুরা বসে  বসে অন্য দিকে আমরা। জানা গেল,সঞ্জয়ের আগামী লক্ষ্য একটি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করা। তার প্রস্তুতি চলছে।  

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments