কথা নিউজ সার্ভিস
দুর্গাপুর,বর্ধমান: কাঠি। নিছক কাঠের ক্ষুদ্র একটি দণ্ড মাত্র? এ দিয়ে কি হয়? একি আদৌ কাজের বস্তু, নাকি এর অকাজই সার! শুধু শুধুই ‘কাঠি’ কি কখনো প্রাসঙ্গিক হয়? নাকি, খোঁচার বদলে ‘কাঠি’র সুড়সুড়ির দাম বেশি? কাঠি কি সুড়সুড়ি দেয়, নাকি জখম করে – এ বিষয়ে, সমাজ বিশেষজ্ঞদের সাফ কথা-“ভালবাসার কাঠির
পরশ পুলকের সুড়সুড়ি দেয় আর বিদ্বেষের কাঠির জখম যায় অনেকই গভীরে।” আরেক কাঠি জাদু কাঠি – যা কিনা মানুষের ভাগ্য বদলে দেয় বলে বিশ্বাস!
কাঠি কি?
মরা ঝোপ জঙ্গলের ছিন্ন ডালের ক্ষুদ্র দন্ডই কাঠি। আবার বারুদ মাথায় জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়ার সাধ্য নিয়ে কাগজের পকেট-বাক্সে ঘুমিয়ে থাকা আদরের দেশলাই কাঠিও নিত্যদিনের জীবনেই প্রাসঙ্গিক। তবে, বাঙ্গলী জীবনের রোজনামচায় চেনা যে কাঠি, তা কিন্তু নড়ে চড়ে চোখের আড়ালে। সেটা থাকে অদৃশ্য। মানুষের পকেটে নয়, ঠাঁই তার লোকের মনের ভিতরে। আর সেটি ব্যবহৃত হয় ষড়যন্ত্র করে কাউকে কাউকে ‘টাইট’ দিতে বা একেবারে নিকেষ করে দিতে। এই অদৃশ্য কাঠিই কিন্তু এখন দারুন প্রাসঙ্গিক একটি বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে বঙ্গ বিজেপির অন্দরে, বাহিরে। কাঠি চলাচলের লুকোনো পথ খুঁজতে মরীয়া সবাই। কার কাঠি, কেই বা করল নিষ্ঠুর এই কাঠিবাজি – তার হদিশ পেতে কলকাতা থেকে দিল্লি জব্বর চর্চা এখন। তবে, কাঠিবাজের খোঁজ মেলেনি, যিনি রাখঢাক না করে খুলে আম কাঠিবাজির অভিযোগ করছেন, তিনি অবশ্য সাহস করে কোনো কাঠিবাজের নামটাই এখনো মুখে আনেননি। দুদিন হলো কাঠিবাজ খোঁজার একটি নতুন ফর্মুলা তিনি দিলেন – “হারা আসন জিততে নয়, প্ল্যান করা হয়েছিল যেটা আসনে কি করে হারা যায় তা ঠিক করতে।” বক্তা জিতেছিলেন মেদিনীপুরে আর হেরে গেলেন দুর্গাপুরে। তার পস্ট দাবি, তিনি হারেননি, তাকে ষড়যন্ত্র করেই ডুবিয়ে দেওয়া হল। কে বা কারা তাকে এই গরম ডাঙায় ডোবালো তা নিয়ে গবেষণা চলছেই। কিন্ত, দিলীপ যেটা করছেননা – সেটা আত্মবিশ্লেষণ।
বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের হেভিওয়েট দাম্ভিক এই বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষ। ভোটে হেরে যাওয়ার পর রাখঢাক না করে পস্টাপস্টিই বলে দিয়েছিলেন – “আমার পিছনে কাঠি করা হয়েছে। তাই এই ফল।” বললেন, তবে তিনি এখনো বললেন না ওই কাঠিটির নেপথ্য মালিকের নাম। যা বোঝা গেল, এখনি আরো খোলসা করে হাটে হাঁড়িটি ভাঙ্গতে চাইছেন না দিলীপ। একটি ফুসমন্তর ছেড়ে আসলে এবার জল মাপছেন তিনি। তার পরিকল্পনা হয়তো আরো সুদূরে! তার মাঝেই চলুক দলের কাঠি খোঁজার অভিযান।
রাজনীতির পণ্ডিতদের মতে, ওই কাঠি যদি মেদিনীপুর থেকে আসে – তার দম্ একরকম, আর যদি দুর্গাপুরের ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দঢ়’ কোনো ‘কাঠি বাবু’কে দিলীপ ইঙ্গিত করে থাকেন তার লক্ষ্য কিন্তু বেশ ভিন্ন। দিলীপের ইঙ্গিতে থাকা মেদিনীপুরের ওই কাঠিটির ডালপালার দুর্গাপুরে বসতি, বেসাতি যেমন রয়েছে, তেমনি দিলীপের রোপন করা এক চারা গাছের হৃষ্টপুষ্ট কাঠি কিন্ত এখন শহর দুর্গাপুরে ‘রাজ’ করে, যা দেখে দিলীপ নিজেই হতভম্ব! হতাশা চাপতে না পেরে কয়েক বারই ক্যাডার, সাপোর্টারদের সামনে সেই ‘কাঠি’ কে ‘খুব কামিয়েছো’ বলে কটাক্ষ করতেও ছাড়েন নি। দলের ভেতর বলেছেন – “ও আমাকে জিততে দিতে চাইছে না। পরে ব্যবস্থা নেবো।” দুর্গাপুরে এসেই দলীয় কর্মীদের সাথে দেওয়াল লিখনে ব্রাশের টাচ দিতে গিয়ে মুখ ফসকে ঠোঁটকাটা দিলীপ এখানকার এমএলএ কে তাচ্ছিল্য করে বলে দিলেন – ‘লক্ষন এখানে আমার নয়, তোমার নামটা থাকতো!’ যা নিয়ে অস্বস্তি ছড়ায় দলের অন্দরে।
আর ফল প্রকাশের দু দিন আগে বর্ধমানে সম্ভাব্য দু’ চারটি ‘কাঠি’কে পাশে বসিয়েই দিলীপ আচমকাই হুঙ্কার দিলেন, “বিজেপিতে যারা আড়কাটি তাদের তাড়িয়ে দিয়ে বিজেপি চলবে নিজের ছন্দেই”। আড়কাঠি বলতে সোজা কথায় – দালাল। তাহলে, জেলার বিজেপিতে কি এখন দালাল রাজ চলছে? এ নিয়ে দলের পূর্ব বর্ধমান জেলা সভাপতি অভিজিৎ তা আলাদা করে কোনো মন্তব্যই করেননি। দুর্গাপুর পশ্চিমের বিধায়ক লক্ষণ ঘোড়ুই ঘনিষ্ঠজনের কাছে বলেছেন, “দিলীপদা অনেক বড় নেতা। ওনার বক্তব্যের ওপর আমার মন্তব্য করা উচিৎ নয়।”এই লক্ষণকে দিলীপ দলের পশ্চিম বর্ধমান জেলা সভাপতির পদে বসিয়েছিলেন, টিকিট দিয়েছিলেন বিধায়ক পদের।
এত ‘কাঠি কথা’ হাঁড়ির ভেতর থেকে যখন রাজ সড়কে চলেই এল, তখন প্রশ্ন উঠতেই পারে – দিলীপের পিছনে এই সব ‘আড়কাঠি’রা অত কাঠিবাজি করলোটাই বা কেন? তারা কি সকলেই ঘাসফুলের সিক্রেট এজেন্ট, নাকি তারা দিলীপেরই ক্ষনে ক্ষনে অপমান, আক্রমনে বিরক্ত, বিধ্বস্ত- এ প্রশ্নটাও উঠতে শুরু করেছে জেলা বিজেপির অন্দরে। একজন ‘কারিয়াকর্তা’ বললেন, “ওনাকে সকলেই ভালবাসতো। সবাই স্বীকার করে বঙ্গ বিজেপিতে ওনার অবদান। কিন্তু, উনি এসে থেকেই যখনতখন একে তাকে অপমান করেছেন। নিজেকে প্রভু সাজিয়ে, বাকিদের পুরাতন ভৃত্য ভেবেছেন। প্রকাশ্যেই খাটো করেছেন দলের নেতাদের। কে সইবে এত সব!” আরেক ছোট ‘প্রভারী’ বলেন, “সাথে মেদিনীপুর থেকে আনা সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে সবসময় ঘুরছিলেন। ওদেরই বেশি গুরুত্ব ছিল। আর জেলার নেতাদের সবার সামনে বারে বারে হালকা করে দিয়েছেন। কারো সম্মানটুকুও রাখেন নি। তাহলে, এখানকার লোকেরা কি একবারও ভাববে না যে – উনি জিতে গেলে ছড়ি ঘেরাবে ওই মেদিনীপুরি ‘বাবু’রা আর তাদের সেবাদাস হয়ে থাকবে আমাদের জেলার লোকেরা! এটা কেউ মেনে নেবে? ওনাকে এবার কাছ থেকে দেখে বুঝে গেছি – উনি এখনো রাজনৈতিক বিচক্ষনতা পাননি। যার তার নামে সকাল সকাল হরদিনই যে কুকথার ফুলঝুরি, এখানকার মানুষ তা ভালোভাবে নেয়নি – তার জন্য দায়ী উনিই। উনি মানুষের সাথে মিশতেই শেখেননি, শুধু গায়ের জোরে এ জেলায় ভোটে জেতা যায় না।”
তবে কি দিলীপের খোঁচায় বিরক্ত, অতীষ্ঠ দলীয় সম্পদেরাই কাঠি হয়ে কাঁদিয়ে ছাড়ল বাংলায় বিজেপি ব্র্যান্ডের রূপকার দিলীপ ঘোষকে? নাকি ‘মমতা-মুগ্ধ’ মানুষই শেষে দুর্মুখ দীলিপকে এভাবে দুরমুশ করে দিল! ভাবছে বঙ্গ বিজেপি।