মন্মথ দাসঃ ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে আরও এক চরিত্র সান্তা ক্লজ। এনিয়ে নানা কাহিনী থাকলেও প্রতি বছরই বড়দিনের সঙ্গে আমাদের মাঝে বিরাজ করেন লাল জামা, টুপি ও সাদা চুল-দাড়িওয়ালা এই সান্তা ক্লজের। উপহার আর জিঙ্গল বেলসের ঝোলা কাঁধে নিয়ে লাল টুকটুকে পোশাক, মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি আর মাথায় সাদা টুপি পরে দোরগোরায় হাজির হন সান্তা ক্লজ। শিশুদের মুখে হাসি ফোটাতে তার জুড়ি নেই। যুগ যুগ ধরে বড়দিনে এভাবেই ছোটদের খুশি করতে হাজির হন সান্তা। সান্তার উপস্থিতি কি আদৌ রয়েছে নাকি সবটা মনগড়া? সান্তা ক্লজ বলে কি কেউ কোনও দিন ছিল? কে এই সান্তা ক্লজ? তাঁর ইতিহাস কী? এই প্রতিবেদনে সেসব তথ্যই তুলে ধরব। সাধারণ মানুষ বিশেষত শিশুদের সান্তা ক্লজকে নিয়ে কৌতুহলের শেষ নেই। আজও মানুষের বিশ্বাস বড়দিনের আগে সাদা গোঁফ দাড়ির লাল পোশাক পরা সান্তা ক্লজ রাতের অন্ধকার এসে লাল ঝোলা থেকে উপহার রেখে যান চুপিসাড়ে। যাকে আজ আমরা সান্তা ক্লজ বলে চিনি তাঁর এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। খ্রিস্টিয় তিন শতকের দিকে খুঁজে পাওয়া যায় লাল পোশাক, লাল টুপি পরা, সাদা ধবধবে দাড়িওয়ালা এই মানুষটিকে। সেন্ট নিকোলাস নামে এক সন্ন্যাসীকে ঘিরে সান্তা ক্লজের কিংবদন্তী শুরু। মনে করা হয় খ্রিস্টিয় ২৮০ সালের দিকে এশিয়া মাইনর বা বর্তমান তুরস্কের পাতারা নামে অঞ্চলে তাঁর জন্ম হয়েছিল। সততা ও দয়ার জন্য় সকল মানুষ পছন্দ করতে তাঁকে। শোনা যায় বেশ ধনী ছিলেন এই মানুষটি। সবসময় সাহায্য করতেন গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষদের। সেন্ট নিকোলাস শিশুদের প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। কথিত আছে, একবার নিকোলাস দাস হিসেবে বিক্রি হতে যাওয়া তিন মেয়েকে রক্ষা করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি ওই মেয়েগুলির বিয়েতে যৌতুক ও যাবতীয় খরচাপাতি করেছিলেন বলে শোনা যায়। তারপর থেকেই তাঁর জনপ্রিয়তা হয়ে যায় আকাশ ছোঁয়া। মানুষের রক্ষক হিসেবে পরিচিতি পান। রেনেসা পর্যন্ত সেন্ট নিকোলাস জনপ্রিয় ছিলেন ইউরোপে। আমেরিকায় তিনি পরিচিতি পান ১৮০০ শতকের শেষের দিকে। ১৭৭৩ ও ১৭৭৪ সালে পরপর দু’বার একটি পত্রিকায় সামনে আসে এক ডাচ পরিবারের সেন্ট নিকোলাসের মৃত্যুবার্ষিকী উৎযাপনের খবর। সেন্ট নিকোলাসকে সংক্ষিপ্ত রূপ ‘সিন্টার ক্লাস’ নামে ওই ডাচ পরিবার ডাকতেন। পরবর্তী সময়ে সিন্টার ক্লস থেকে মূলত সান্তা ক্লজ নামটির জন্ম হয় বলে মনে করা হয়। ১৮২০ সালের দিন থেকে বড়দিন উপলক্ষ্যে বিজ্ঞাপন দিতে দেখা যায় বিভিন্ন দোকানগুলিকে। অনেক সময়ই পত্রিকায় বিশেষ সংখ্যা বের হতো যেগুলিতে প্রায়ই ছাপা হতো সান্তা ক্লজের ছবি। ১৮৪১ সালে ফিলাডেলফিয়ার একটি দোকানে তৈরি করা হয়েছিল একটি সান্তা আকৃতির মানুষ। যা দেখতে ভিড় জমিয়েছিল হাজার হাজার শিশু। ১৮২২ সালে ক্লেমেন্টে ক্লার্ক মুর নামে একজন বড়দিন উপলক্ষ্যে লিখেছিলেন একটি কবিতা, সেটির শিরোনাম ছিল An Account of a Visit From St. Nicholas। এই কবিতায় যে চিত্র ফুটে উঠেছিল তার সারমর্ম হল লাল পোশাকে সাদা দাড়িওয়ালা এক সন্ত আটটি হরিণ টানা গাড়িতে উড়ে উড়ে শিশুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে উপহার বিতরণ করছেন। ১৮৮১ সালে থমাস ন্যাসট নামক একজন আমেরিকান কার্টুনিস্টের আঁকা ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হলে সান্তা ক্লজের এই সাজ ব্যাপক খ্যাতি পায়। সেখানে সান্তা হরিণটানা গাড়িতে চড়ে কাঁধে উপহারভর্তি ঝোলা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদের উপহার দেওয়ার চিত্র ফুটে ওঠে, এই ছবিটি গোটা বিশ্বে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এরপর থেকেই গোটা বিশ্বে সান্তা ক্লজের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। সান্তা ক্লজকে নিয়ে এমনই সব ভিন্ন ভিন্ন গল্প কথিত।
ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সান্তার জন্য খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। শুধু তাই নয়, সান্তা তাঁর উপহারের ঝুলি থেকে তাদের মনের মতো জিনিস দিয়ে যাবেন বলেও বিশ্বাস করে ছোট ছোট মুখগুলো। সান্টাক্লজ পাশ্চাত্য সংস্কৃতির একটি কিংবদন্তি চরিত্র। তিনি সেইন্ট নিকোলাস, ফাদার খ্রিষ্টমাস ক্রিস ক্রিঙ্গল বা সাধারণভাবে “সান্টা” নামে পরিচিত। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি খ্রিষ্টমাস ইভ বা ২৪ ডিসেম্বর তারিখের সন্ধ্যায় এবং মধ্যরাতে অথবা ফিস্ট ডে বা ৬ ডিসেম্বর তারিখে (সেন্ট নিকোলাস ডে) ভাল ছেলেমেয়েদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাদের উপহার দিয়ে যান। এই কিংবদন্তির উৎস ঐতিহাসিক চরিত্র উপহার-প্রদানকারী সেন্ট নিকোলাসের জীবন সংক্রান্ত সন্তজৈবনিক উপাদানসমূহ। গ্রিক ও বাইজানটাইন লোককথাতেও বাসিল অফ সিসেরিয়া সংক্রান্ত একই প্রকারের একটি কিংবদন্তির উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। বাসিলের ফিস্ট ডে বা ভোজদিবস পয়লা জানুয়ারি গ্রিসে উপহার আদানপ্রদানের দিন। ১৮৮১ সালে টমাস নাস্ট অঙ্কিত সান্টাক্লজের চিত্র, ক্লিমেন্ট ক্লার্ক মুরের সঙ্গে নাস্ট সান্টাক্লজের বর্তমান রূপকল্পটির সৃজনে সহায়তা করেছিলেন। সান্টাক্লজের আধুনিক রূপকল্পটিতে তাঁকে ছোটো ছেলেমেয়েদের বড়দিনের ইচ্ছেগুলির শ্রোতারূপে দর্শানো হয়। সেন্ট নিকোলাসের প্রকৃত চিত্রটি ছিল এক বিশপের আলখাল্লা পরিহিত সন্তের চিত্র। কিন্তু আজকের সান্টাক্লজ সাধারণত হন কোনো স্থূলকায়,হাস্যমুখর এবং সাদা-দাড়িবিশিষ্ট ব্যক্তি। তার পরনে থাকে সাদা কলার ও কাফযুক্ত লাল কোট, সাদা কাফযুক্ত লাল ট্রাউজার্স,কালো চামড়ার বেল্ট ও বুটজুতো। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিশিষ্ট ক্যারিকেচারিস্ট ও রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট টমাস নাস্টের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সান্টাক্লজের এই রূপটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই রূপকল্পের প্রচার ও তার জনপ্রিয়তার প্রসারে সহায়তা করে একাধিক গান, রেডিও,টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে সান্টাক্লজের রূপটি আমেরিকান সান্টার মতো হলেও এই অঞ্চলে তিনি ফাদার খ্রিষ্টমাস নামেই সমধিক পরিচিত। সান্টাক্লজ-সংক্রান্ত একটি কিংবদন্তি অনুসারে, তিনি সুদূর উত্তরে এক চিরতুষারাবৃত দেশে বাস করেন। আবার সান্টাক্লজ-সংক্রান্ত আমেরিকান উপাখ্যান অনুসারে, তার নিবাস উত্তর মেরুতে। অন্যদিকে ফাদার খ্রিষ্টমাসের নিবাস মনে করা হয় ফিনল্যান্ডের, ল্যাপল্যান্ড প্রদেশের কোরভাটুনটুরি পার্বত্য অঞ্চলে। সান্টাক্লজ তার স্ত্রী মিসেস ক্লজ, অসংখ্য জাদুক্ষমতাসম্পন্ন এলফ, এবং আট-নয়টি উড়ন্ত বলগাহরিণের সঙ্গে বাস করেন। অপর একটি উপাখ্যান অনুসারে, সান্টাক্লজ সারা বিশ্বের শিশুদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে তাদের আচরণ (“দুষ্টু” ও “লক্ষ্মী”) অনুযায়ী দুই ভাগে ভাগ করেন। তারপর খ্রিষ্টমাস ইভের রাতে তিনি লক্ষ্মী ছেলেমেয়েদের খেলনা, লজঞ্চুস ও অন্যান্য উপহার দেন এবং কখনও কখনও দুষ্টু ছেলেমেয়েদের কয়লা দিয়ে যান। এই কাজ তিনি সম্পন্ন করেন তার কারখানায় কর্মরত এলফ ও তার স্লেজগাড়ির বাহক বলগাহরিণগুলির মাধ্যমে। অন্যদিকে, শিশুদের সান্টাক্লজ-সংক্রান্ত বিশ্বাসগুলি শিক্ষা দেওয়ার বিপক্ষেও কেউ কেউ মত প্রকাশ করেন। কোনো কোনো খ্রিষ্টান মনে করেন, সান্টা সংস্কৃতি ধর্মীয় উৎস ও বড়দিনের উদ্দেশ্য থেকে জনসাধারণকে বিচ্যুত করছে। অন্যান্য সমালোচকদের মতে, সান্টাক্লজ-সংক্রান্ত উপকথাটি একটি সুবিন্যস্ত মিথ্যা এবং যেকোনো পিতামাতার পক্ষেই তাদের ছেলেমেয়েদের এই মিথ্যা অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপনে শিক্ষাদান অনৈতিক। আবার কেউ কেউ সান্টাক্লজকে বড়দিনের ছুটির বাণিজ্যকরণের প্রতীক হিসেবে তার বিরোধিতা করে থাকেন।