কথা নিউজ সার্ভিস
দুর্গাপুর,আসানসোল, বর্ধমান, বাঁকুড়া:
-‘হোলি, কব হ্যায় হোলি?’
– ‘সর্দার ৪ জুন!’
এক্সিট পোলের ‘ওলটপালট হাওয়া’য় রাজ্যের শাসক ঘাসফুল শিবিরের গণনায় পাঠানো বেশিরভাগ এজেন্টের মনোবল যখন তলানির দিকে, তখন সর্দারেরা হোলির খোঁজ করায় কিঞ্চিৎ অস্বস্তি ঘাসফুল, কাস্তে-হাতুড়ি পাড়ায়, তবে জেলায় জেলায় পদ্মবন কিন্তু হর্ষ’র বর্ষায় ভেসে যাচ্ছে। সেই ভেজানো বাতাসে টন টন আবিরের ধোঁয়ার গেরুয়া মেঘ ঠিক কতদুর ভাসবে, তার জল্পনা ইতিমধ্যেই তুফান তুলেছে পাড়ায়, মহল্লার চায়ের কাপে। কি হয়, কি হয়!
দুরু দুরু বুক। চড়া রোদে শহর-গঞ্জের শুনসান পথঘাট আরো যেন চওড়া। আর হাতে গোনা কয়েক ঘন্টা পরই রোদ-গরমকে তুচ্ছ করে শত শত মাথার দুর্বার
অকাল হোলি দেখবে দক্ষিণবঙ্গের পথঘাট। আকাশে-বাতাসে উড়বে আবির। তবে, তার রঙ কি হবে, তা ঠিক করবে জেলায় জেলায় নিশ্ছিদ্র প্রহরায় প্রহর গোনা হাজার হাজার ইভিএম।
তার তোয়াক্কা না করেই কোন কোন দল অবশ্য ভোটের পরই কোথাও কোথাও ‘বিজয় মিছিল বের করে সদর্প উল্লাসে পাড়া কাঁপিয়েছে। অন্যদল তাকে ‘আত্ম প্রবঞ্চনা’ বলে কটাক্ষও করেছে। এরই মাঝে রিমালের পাড়া বেড়ানো বঙ্গের ভোট বাসরে। কিছু লন্ডভন্ড, এবং কোথাও চেনা ছন্দ, তারপর ভোটের তাপ ছাপিয়ে ফের প্রকৃতির উত্তাপ। রোষানলে পুড়ছে জনজীবন। শিল্পাঞ্চল থেকে গ্রামাঞ্চল।
“অবাক করার মতো ব্যাপার এটাই যে লাল আবিরের আলাদা করে কোনো অর্ডারই নেই। অথচ এক সময় এটাই ছিল মূল ব্যবসা,” বললেন রানীগঞ্জের ষাটোর্ধ আবির ব্যবসায়ী চন্দ্রনাথ জয়সোওয়াল। তবে, অন্য কথা জামুড়িয়ার আবির বিক্রেতা কবিলাল ঘোষের। তার দাবি, “এখানে দু’দিন আগেই ২০০০ প্যাকেট লাল আবিরের অর্ডার দিয়েছেন এখানকারই তিন যুবক। অ্যাডভান্সও দিয়েছেন। কারা জিতছেন ওসব জেনে আমার কি লাভ?”
পূর্ব-পশ্চিম বর্ধমান জেলাগুলির তিনটি আসনের দুটিতে গেরুয়া ঝড়ের পূর্বাভাস নাকি আত্মতুষ্টিতে ভোগাচ্ছে পদ্ম শিবিরকে আর একটিতে রসেবসে ঘাসফুল। তাই কি বিজেপির বর্ধমান-দুর্গাপুরের ব্র্যান্ডেড প্রার্থী দিলীপ ঘোষের আত্মবিশ্বাস যাকে বলে তুঙ্গে ? দিলীপ বললেন,”কি আর বলবো মুখে? যা দেখার ৪ জুন দেখে নেবেন। ভালো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলে এতটা কমফোর্টে হয়তো থাকতাম না।” পূর্ব বর্ধমান জেলা বিজেপির সভাপতি অভিজিত তা’র স্পষ্ট দাবি, “চার তারিখে বর্ধমানের নীল আকাশে দেখবেন শুধুই গেরুয়া ফাগের ধোঁওয়া। আমাদের সব কর্মী –সমর্থকেরা টগবগ করে ফুটছে। অপেক্ষা শুধু সময়ের”। সিপিএম প্রার্থী সুকৃতি ঘোষাল অবশ্য আলাদা মেজাজের মানুষ। এসব চটুল উল্লাস থেকে অধ্যাপক এই মানুষটির অবস্থান শতযোজন দূরে। আবির শুনে হেসে ফেললেন। তার কথায়,” এসব তো ছেলেছোকরাদের বিষয়। আমাদের আর কি সে বয়স আছে”?
সিপিএমের পূর্ব বর্ধমানের জেলা সম্পাদক সৈয়দ হোসেন বলেন,” মানুষ আনন্দ পেলে মন রঙীন হয়। এটা তো ভাল কথা। কিন্তু, আমরা তো সারাটা বছরই লড়াই এর ময়দানে থাকি। জয় বিজয়ের ঘটা করে আলাদা উল্লাস করার খুব একটা দরকার পড়ে না। পার্টি কখনো আবির কেনে না। কর্মী-সমর্থকেরা নিজেদের উদ্যোগে করলে সেটা আলাদা ব্যাপার”।
কোন আবির উড়বে বিষ্ণুপুরের আকাশে ? মিঞা – বিবির টক্করের রণভূমিতে দক্ষিণবঙ্গজুড়ে সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। স্বামীর জয়ে দু’হাত ভরে মন্দির নগরীতে গেরুয়া আবির উড়িয়ে ছিলেন যে স্বতঃস্ফুর্ত সুজাতা,আজ সেই সুজাতা মন্ডলের কর্মী-সমর্থকেরা আঁতিপাতি করে খুঁজছেন সবুজ আবির। কারন,তার শিবিরের দৃঢ় প্রত্যয় খন্ডঘোষ,বিষ্ণুপুর আর ওন্দার মারকাটারি মার্জিন নাকি এবার সুজাতার প্রতিদ্বন্দ্বী,তার প্রাক্তন স্বামী সৌমিত্র খানকে বিষ্ণুপুরের ধুলোয় মিশিয়ে দেবেই। সুজাতার দাবি, “আরে বিজেপি প্রার্থী তো ভোটের দিনেই বুঝে গেছে -এবার হেরে ভুত হয়ে যাবে। তো, ছেলেরা আনন্দ করবে না”?
কি বলছেন সৌমিত্র? “আর তো দুটো দিন। ৪ তারিখে সব নাচন কোদন বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের আলাদা করে আবির স্টক করতে হয় না। বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়ার ঘরে ঘরে গেরুয়া”।
বাঁকুড়ার বিদায়ী সাংসদ, বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকার নিজেও প্রবল প্রত্যয়ী। তার কথায়, “আমি আর কি বলবো আলাদা করে,এখানকার মানুষ যা বলার সব ইভিএমেই বলে দিয়েছেন”। আর ঘাসফুলের অরুপ চক্রবর্তী? কি বলছেন তিনি? তার দাবি, “সুভাষ ঠিক কথাই বলেছেন, যা বলার মানুষ বলেই দিয়েছে। মুশকিলটা হল—উনি ঠিকমতো শুনতে পাননি মানুষ কি বলেছে। বাঁকুড়া এবার নতুন করে ২০১৪’র সবুজ হোলি খেলবে। সবাই প্রস্তুত”।
লাল,নীল,সবুজের মেলায়, গেরুয়াটাও যে এখন একটা চড়া রঙ, তা জানেন ব্যবসায়ীরাও। কাটোয়া শহরের মূল উৎসব কার্তিক লড়াই। তখনো বাতাসে আবির ভাসে। এবারের ভাজপা প্রার্থী অসীম সরকার ভোটের আগে হরেক গান বেঁধে মঞ্চ দাপিয়ে ভোটারের মন জয়ের চেষ্টা করলেও,ফলের মুখে কেমন যেন মিইয়ে গেছেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের চিকিৎসক প্রার্থী শর্মিলা সরকারের হাসি মুখে কোনোদিনই কুকথা শোনা যায়নি। ফল ঘোষণার আগে বললেন, “এটা আমার জন্মভূমি। বহু বছর পর ফিরে এসে মানুষের অনেক ভালোবাসা পেলাম। এর চেয়ে আর কোনো বড় রঙ হয় কি”?
না,তা হয় না।
তবে,দু’মাস ধরে দমফাটা উত্তেজনার পর কাটোয়া থেকে আসানসোল,পুরুলিয়া থেকে বিষ্ণুপুর অথবা সিউড়ি,বোলপুর থেকে বর্ধমান – সর্বত্রই দলমত নির্বিশেষে বিশেষতঃ যুবা, মাঝবয়সীদের চাহিদা কিন্তু একটাই- ‘হোলি চাই’। সম্ভবতঃ তাই,৪ জুন দক্ষিণবঙ্গের প্রকৃতি,পরিবেশ সমস্বরে বলে উঠবে- ‘হোলি হ্যায়!’ তবে,শর্ত থাকে যেন একটাই- ‘এই হোলিও দোলের মতো হোক সৌহার্দের,ভ্রাতৃত্বের।’