প্রণব রায় ও জয় লাহা,দুর্গাপুরঃ আপাত স্বচ্ছলদের জন্য এবার বদলাতে চলেছে রাজ্যের স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের প্রাপ্য সুবিধার ধরন। ‘কো- পেমেন্ট’ বা সহ-অর্থ দায়ভার হিসাবে দারিদ্রসীমার ওপরে থাকা স্বাস্থ্যসাথী সুবিধাভোগী পরিবারগুলিকে এবার চিকিৎসার খরচ আর বিনি পয়সায় নয়, তাদেরকে গুনতে হবে নূন্যতম হারে ব্যয়ভার। রাজ্যের ক্নিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশন- যেটি স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের ব্যবহার সংক্রান্ত অন্যতম নিয়ামক সংস্থা,তার শীর্ষকর্তারা শুক্রবার দুর্গাপুরে সাফ জানিয়ে দিলেন, ঠিক কতটা খরচের ভার বইতে হবে স্বচ্ছলদের,তারই পরিমাপের কাজ চলছে। এদিন শহরের ‘দ্য মিশন হাসপাতাল’র দ্বিতীয় জরুরী বিভাগ – ‘এমারজেন্সী – ২.০’র দ্বারোদ্ঘাটন উপলক্ষে সিটি সেন্টারের একটি পাঁচতারা হোটেলে আয়োজিত কনফারেন্সের পর সাংবাদিক বৈঠকে রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান,অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অসীম কুমার বন্দ্যাোপাধ্যায় বলেন, “স্বাস্থ্যসাথী এমন একটি প্রকল্প যা ভূ- ভারতের আর কোনো রাজ্যেই নেই। সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় বড় বড় হাসপাতালে কঠিন রোগের চিকিৎসার এত সুযোগ আর কোনো রাজ্য সরকারই করে উঠতে পারেনি। এই প্রকল্পে, এই মূহুর্তে রাজ্যের ১০ কোটি মানুষ নথীভুক্ত”। তবে, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে নথীকৃত উপভোক্তারা যে সময়ে সময়ে বড় বড় হাসপাতালগুলির চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বা তাদেরকে ‘স্বাস্থ্যসাথী’ শোনামাত্র ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সে প্রসঙ্গে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এমন অভিযোগ আগে বহুমাত্রায় আসছিল। ক্রমশঃ সরকার কড়া মনোভাব নেওয়ায় তা কমে আসছে। মনে রাখতে হবে, আমাদের সমাজের আর্থিকভাবে অক্ষম মানুষ যারা তাদের কাছে চিকিৎসার অবলম্বন ছিল শুধুমাত্র সরকারি হাসপাতাল। এখন এই স্বাস্থ্যসাথী কার্ড তাদেরকে মিশন হাসপাতালের মতো এই সব বড় বড় হাসপাতালের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার সাহসটা দিয়েছে। অভিযোগ অবশ্যই রয়েছে রাজ্যের কিছু কিছু হাসপাতালের বিরুদ্ধে, যে তারা স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দেখালেই বলে দেয় বেড খালি নেই। এরকম প্রচুর ক্ষেত্রে আমরা অভিযোগ পাওয়ার পর সত্বর ব্যবস্থা নিয়েছি”। রাজ্যের টার্সিয়ারি কেয়ার এবং সুপার স্পেশালিটি বা মাল্টি স্পেশালিটি হাসপাতালগুলির পক্ষ থেকে একটি কথা রোগীর পরিবারকে প্রায়শঃই বলা হয়, যে, ‘স্বাস্থ্যসাথীর’ বেড খালি নেই। তাহলে, প্রশ্ন ওঠে,ওইসব হাসপাতালে কি স্বাস্থ্যসাথী উপভোক্তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে আলাদা শয্যা বা ওয়ার্ড সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারিত করা থাকে? শহর দুর্গাপুরের গান্ধী মোড়ের একটি ও বিধাননগরের একটি বেসরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ সবচেয়ে বেশী। বিষয়টিতে রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ না। স্বাস্থ্যসাথী উপভোক্তা রোগীদের জন্য আলাদা এমন ধরনের শয্যা সংখ্যা সরকার বা কমিশন কেউই কখনই চিহ্নিত করে দেয়নি। যে সব হাসপাতাল এমন কথা বলে তারা রোগীদের ভুল বোঝাচ্ছে। অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে”।প্রসঙ্গত, শুক্রবারই দুর্গাপুরেই রাজ্যের স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের কার্য্যনির্বাহী উপদেষ্টা সুদীপ্ত ভট্টাচার্য্য জেলার স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি জরুরী বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের মূল বিষয়ই ছিল,স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের সুবিধা প্রাপকদের প্রতি কিছু বেসরকারী হাসপাতালের বঞ্চনা ও প্রতারনাকে ঘিরে। পশ্চিম বর্ধমান জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ শেখ মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, “শুধু আমার কাছেই মাসে ১৫-২০ টির মতো এরকম অভিযোগ আসে। তাছাড়াও মহকুমা শাসকদের কাছে বা আসানসোলের অতিরিক্ত জেলা শাসকের কাছে আলাদাভাবে এবং সরকারি পোর্টালেও বহু অভিযোগ জমা পড়ে থাকে”। তিনি বলেন, “এদিন উপদেষ্টা নিজে দ্য মিশন, হেল্থ ওয়ার্ল্ড আর বিবেকানন্দ হাসপাতাল ঘুরে দেখেন এবং কিছু অভিযোগ খতিয়ে দেখেন”। পাশাপাশি তিনি বলেন, “ওই সব হাসপাতালগুলিতে সত্যিই এখন রোগীর চাপ বেড়েছে। অনেক সময় সত্যি সত্যিই শয্যা খালি না থাকায় রোগী ফিরিয়ে দেন তারা”। ওদিকে, দ্য মিশনের বৈঠকে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে ছিলেন ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ্ প্রোভাইডার্স অফ ইন্ডিয়া’র মহা নির্দেশক ডাঃ গিরিধর জে জ্ঞাণী। এ রাজ্যের স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের বিষয়ে তিনিও তার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এদিন তিনি বলেন, “ কলকাতার বাইরে দুর্গাপুরের মতো শহরগুলিতে মিশনের মতো যে সব হাসপাতাল চলছে,তাদের ওপর কোভিড পরবর্তী সময়ে ভীষণ মাত্রায় রোগীর চাপ বেড়ে গেছে। সবাই এখন ভালো চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ব্যবহার করে এসব হাসপাতালে আসতে চাইছেন। তাই সমস্যাটা বেড়েছে”। তিনি বলেন, “আমরা এপিএল তালিকাভুক্ত স্বচ্ছল পরিবারগুলির জন্য স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে কিঞ্চিৎ বদল আনার কথা ভাবছি। স্বচ্ছল পরিবারগুলিকে বিশেষ করে অর্থোপেডিক রোগীদের জন্য হয়তো ইমপ্ল্যান্টের দাম দিতে হবে। মোট চিকিৎসা ব্যয়ের কিছু শতাংশের ভার তাদের বইতে হবে”। তিনি বলেন, “ ঠিক কতটা তাদের বইতে হবে,তার পর্য্যালোচনা এখনো চলছে”।রোগী পিছু হাসপাতালের শয্যা সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গই দেশের শীর্ষে,একথা জানিয়ে ডাঃ জ্ঞানী এদিন বলেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম মোতাবেক,দেশে বা রাজ্যে প্রতি ১০০০ রোগীর জন্য গড়ে ৩.৫ টি শয্যা থাকা বাঞ্ছনীয়। এ রাজ্যে রয়েছে ১.২৪টি। পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যগুলির মধ্যে আসামে ০.৭৭,ওড়িষায় ০.৬১টি,ঝাড়খন্ডে ০.৮০টি আর সবচেয়ে দুরাবস্থা বিহারে – যা ০.৩টি। সেদিক দিয়ে পরিকাঠামোর বিচারে বাংলার অবস্থা ভাল”। হাসপাতালের পরিকাঠামোর মানোন্নয়ন সম্পর্কে দুর্গাপুরের দ্য মিশন হাসপাতালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডাঃ সত্যজিৎ বসু বলেন, “আরো ভালভাবে,আরো দ্রুত পরিষেবা দেওয়ার জন্যই আমরা আমাদের হাসপাতালে আরো একটি জরুরি বিভাগ চালু করলাম”।
বদলাচ্ছে স্বাস্থ্যসাথীঃ এবার টাকা গুণতে হবে স্বচ্ছলদের
আপাত স্বচ্ছলদের জন্য এবার বদলাতে চলেছে রাজ্যের স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের প্রাপ্য সুবিধার ধরন। ‘কো- পেমেন্ট’ বা সহ-অর্থ দায়ভার হিসাবে দারিদ্রসীমার ওপরে থাকা স্বাস্থ্যসাথী সুবিধাভোগী পরিবারগুলিকে এবার চিকিৎসার খরচ আর বিনি পয়সায় নয়, তাদেরকে গুনতে হবে নূন্যতম হারে ব্যয়ভার।
RELATED ARTICLES