মৌ বন্দ্যোপাধ্যায়,দুর্গাপুরঃ “হেলিকপ্টার পাক মেরে গর্জায়,এক তিলও নেই রেডিও একটিভিটি,” পোখরানের পরমাণু বিস্ফোরণের পর লিখেছিলেন কবি জয় গোস্বামী। কুড়ি বছর পর পক্ষকাল টানা হেলিকপ্টারের চক্কর দেখলো দুর্গাপুর – কখনও মুখ্যমন্ত্রী,কোনোদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী,তো কোনোবেলা ভোট প্রচারে আসা কোনো চিত্রতারকা! শিল্পশহরের খেয়ালী আকাশটা এখন ফাঁকা পাওয়া দায় আর এ তালুকের জমিনটাও এখন দারুণ গরম নেতা মন্ত্রীদের অনবরত দাপাদাপিতে। বলা মুশকিল,মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই মাটিতে বিরোধী তেজস্ক্রিয়তার ‘উষ্ণতার’ ঠিক কতটা আঁচ আন্দাজ করতে পেয়েছেন তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার নিরিখে!
“নেতা আসে নেতা যায়,ভোট আসে ভোটও যায় – শহরটা সেই দাঁড়িয়ে ঠায়, হাজারো চিন্তা শিষ্ট মাথায়,বেলা যায়,বল গড়ায়!”
কিন্ত,বল শেষ অব্দি কোন পকেটে গড়ায় – লাখ টাকার প্রশ্ন এখন সেটাই।
কিন্ত,আরো একটি প্রশ্নের সামনে এবার দাঁড়িয়ে শিল্পশহরের ঘাসফুল। দলনেত্রীর টানা এ শহরে ঘাঁটি গেড়ে থাকায় কি উজ্জীবিত হলো শুকিয়ে যাওয়া ঘাসফুল, নাকি তাঁর দুয়ারে পা রাখতে পারা না পারার রেসারেসিতে আরো টুকরো টুকরো হলো ঘাসফুলের ‘সাজানো বাগান?’
পর্যবেক্ষকদের মতে – হেভিওয়েট দলনেত্রীর দুর্গাপুর যাপনের আড়াআড়ি প্রভাব পড়েছে এখানকার তৃণমুল কংগ্রেস শিবিরে আর লম্বালম্বি চাপ বেড়েছে মুখ্য বিরোধী পদ্মফুল শিবিরে। আবারো প্রশ্ন – দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্গাপুরে একটানা থাকাটা কি এবার তৃণমূলের পালে সত্যিই হাওয়া আনছে দুর্গাপুরে? তাই কি তার আগাম আঁচ পেয়ে প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা মমতার দুর্গাপুরের থাকাকে দফায় দফায় কটাক্ষ করেছেন, প্রকাশ্য সভায়? বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষ মুখ্যমন্ত্রীর দুর্গাপুর থেকে হেলিকপ্টারে এই ঘনঘন উড়ানকে স্ট্যান্ডে সাইকেল রাখার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আরো এক ধাপ চড়িয়ে দলেরই আরেক শীর্ষ নেতা অমিত শাহ কি তার ‘হতাশা’ ঢাকতেই দুর্গাপুরের জনসভায় বলে দিলেন ‘পাঁচ দিন নয়,পাঁচ বছর ধরে এখানে থাকলেও এই আসন পাবে না দিদি’। অমিত শাহের এই ‘উচ্চাশা’কে সম্ভবত নস্যাৎ করে দলনেত্রীর টানা দুর্গাপুরে উপস্থিতি উজ্জীবিত করেছে শাসকদলের স্থানীয় নেতা কর্মীদের,বিশেষত দলের শ্রমিক সংগঠনকে। দূর্গাপুর শ্রমিকের শহর। শ্রমিক ভোটার নিয়েই মূলতঃ দুর্গাপুর পূর্ব ও পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্র। অসংগঠিত ক্ষেত্রে আর শিল্পে ঠিকামজুরের শক্তিতে আইএনটিটিইউসির ক্ষমতা বেশি হলেও,স্থায়ী মজুরের ভিত্তিতে সিটুর ক্ষমতাই এখনও বেশি। দুর্গাপুর পূর্ব কেন্দ্রে দুর্গাপুর স্টিল প্লান্ট,মিশ্র ইস্পাত কারখানার শ্রমিক,কর্মী ও তাঁদের পরিবারের ভোটারের সংখ্যাই বেশি। এই দুই কারখানার অসংগঠিত শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। অন্যদিকে দুর্গাপুর পশ্চিমে রয়েছে শিল্পতালুকের বহু ছোট,বড় বেসরকারি কারখানা,রাজ্য সরকারের ডিপিএল ও দুর্গাপুর ক্যামিকেলস লিমিটেড ও রাষ্ট্রায়ত্ত ডিভিসি ডিটিপিএস কারখানা। এই সব কারখানায় অসংগঠিত শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার ৫০০ জন। এই বিশাল সংখ্যক স্থায়ী আর অসংগঠিত শ্রমিকই বরাবর এখানকার যে কোনো ভোটের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক। দুই বিধানসভা মিলিয়ে অসংগঠিত শ্রমিক সংখ্যা বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ডিএসপিতে। যারা দুর্গাপুর পূর্ব,পশ্চিম কেন্দ্রের ভোটের ভাগ্য বিধাতা। আগের লোকসভা নির্বাচনে এই দুই কেন্দ্র মিলিয়ে ৭৬ হাজার ভোটের লিড পায় বিজেপি। কিন্তু কেন? শক্তিশালী আইএনটিটিইউসি ও সিটুর ভূমিকা কী ছিল? তৃণমূলের হাত থেকে রক্ষা পেতে সিটুর বহু ভোট সরাসরি গিয়েছিলো পদ্মে,যা প্রমাণিত। আইএনটিটিইউসি নিজেও ছিল বিস্তর দ্বিধা বিভক্ত। নেতৃত্বের অভাবে ভুগছিল আইএনটিটিইউসি। তা ছাড়াও একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে সংগঠনের উপরই ক্ষোভ ছিল সদস্যদের। তাই,আইএনটিটিইউসির বহু ভোটও পেয়েছিল বিজেপি। সবার ওপর ২০১৭ সালে দুর্গাপুর নগর নিগমের ভোটে সন্ত্রাস,সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার ‘কেড়ে’ নেওয়ার হতাশার রাগ সুদে-আসলে উসুল করেছেন ভোটাররা গত লোকসভার ইভিএমে। ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটে পরিস্থিতি কিছুটা শাসকের অনুকূলে আসে। পূর্বে জেতে তৃণমূল। কিন্তু,পশ্চিমে ফের ফোটে পদ্ম। এবার দুই বিধানসভায় পরিস্থিতি কিন্ত অনেকটাই তৃণমূলের পক্ষে। চাপে পড়ে শাসকের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব অনেকটাই কমেছে। দ্বিধা বিভক্ত আইএনটিটিইউসিও অনেকটাই এখন সঙ্ঘবদ্ধ,বলে দলের শীর্ষ নেতাদের দাবি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটানা ১২ দিন দুর্গাপুরে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে এখান থেকেই বিভিন্ন জেলায় প্রচার করায় এবার শাসকদলের নেতা,কর্মীদের মনোবল বেড়েছে বহুগুণ,বলে দলেরই নেতৃত্বের অভিমত। মুখ্যমন্ত্রীর সভায় শ্রমিকদের উপস্থিতিও বেড়েছে। বেশ উদীপ্ত তৃণমূল কর্মীরা। এই দুই কেন্দ্রে আগের লোকসভা নির্বাচনে জেতার ‘অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস’ এ কিছুটা ঢিলেঢোলা মনোভাব বিজেপির। আর, সেখানেই একের পর এক চাটাই-বৈঠক,পথ সভা,বুথ স্তরের কর্মী বৈঠক করে নিজেদের সংগঠিত করছে তৃণমূল। এবারও এই দুই কেন্দ্র মিলিয়ে এগিয়েই থাকবে বিজেপি,তা মানছেন শাসকদলের জেলা নেতারাও। তবে,আগের তুলনায় বিজেপির লিড অর্ধেক হয়ে যাবে বলেই মনে করছেন তাঁরা। লিড অর্ধেক করার জন্যে শ্রমিক সংগঠনকে আরো একত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে,রোজই হচ্ছে। সংগঠনের নিচু তলার সদস্যদের আরো সক্রিয় করা হয়েছে,বলে জেলা সভাপতির দাবি। আইএনটিটিইউসির জেলা সভাপতি অভিজিৎ ঘটক বলেন, ” আগের ফলাফল ভুলে যান। এবার হবে উল্টো ফল। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে আইএনটিটিইউসি। ঐক্যবদ্ধ আইএনটিটিইউসি এবার ভোট ময়দানে বাজিমাত করবেই।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেন, “দিদি রয়েছেন পাশে এটা সত্যিই অনেকটা উজ্জীবিত করেছে আমাদের। তাই,এবার সবাই মিলেই বর্ধমান – দুর্গাপুর কেন্দ্রে বিজেপিকে হঠাতে কোমর বেঁধে নেমেছি”। বিজেপির হেভিওয়েট প্রার্থী দিলীপ ঘোষ প্রচারের শেষ লগ্নে এসে বুধবার বর্ধমানে প্রকাশ্যেই বললেন, “মমতা ব্যানার্জি এখানে বসেবসে পুলিশ আর দলের নেতাদের নিয়ে ঘুঁটি সাজিয়েছে। তাই,পুলিশ আর আমাদের কোনো কথাই শুনছেনা। যেখানে সেখানে আটকে দিচ্ছে”।
কি বলছেন সাধারন ভোটারেরা?
# “উনি এখান থেকে রাজ্য সফর করবেন বলে সকাল বিকাল রোজ দুঘন্টা ধরে রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে পুলিশ। এটা আমার মতো বহু মানুষের ভালো লাগেনি” – সুবীর ঘোষাল, মিশ্র ইস্পাত কারখানার শ্রমিক
# “হোক দেরি, মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য একটু দাঁড়াবো না? ওনার কিছু হয়ে গেলে আর লক্ষীর ভান্ডার পাবো” – গুড়িয়া সিং,গৃহ পরিচারিকা,বরফকল বস্তি
# “মুখ্যমন্ত্রী এতদিন ধরে শহরে রইলেন,একদিন বেনাচিতিতে রাস্তায় হাঁটলেন, ভালো লাগলো। অমিত শাহ,কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অর্জুন মেঘওয়াল সাতদিন পড়ে রইলেন। কিন্তু সব পুলিশ ওনাদের খাতির,যত্ন,নিরাপত্তায় এতদিন টানা বড়লোকদের হোটেল পাহারা দিলো,আর পরপর চুরি হলো তার ২ মাইলের মধ্যে। চোর ধরার টাইম পেলনা পুলিশ। এটা মেনে নেয়া যায়না” – সুধীর ঘোষ,সিটি সেন্টারের চুরি হওয়া বাড়ীর গৃহকর্তা# “মুখ্যমন্ত্রী আমাদের পাড়ার বাসিন্দা ভেবে গর্ব হচ্ছিল। সারা দুনিয়ায় এখন উনিই বাঙালীর মুখ” – অশোক দেব,বিপণন সংস্থার কর্মী