কথা নিউজ সার্ভিসঃ ভোট হল। ষষ্ঠ দফার ভোটে ইভিএমে যতবার ‘বিপ’ দিল গরীব জেলা বাঁকুড়া,পুরুলিয়া,ততবার কি নতুন করে বুক ঢিপ্ ঢিপ্ করলো জেলাগুলির প্রান্তিক ভোটারদের? চার জুন যাদের কপালে জয় তিলক এঁকে দেবে,তারা কি পরের পাঁচটা বছর আদৌ কান করে শুনতে পাবেন গরীবের শুকনো জঠরের কান্না? কারণ,ভোট ময়দানে যুযুধান প্রধান দলগুলির প্রায় প্রতি প্রার্থীই ক্রোড়পতি! ‘কোন বনেগা ক্রোড়পতি’র টেলি-জুয়ায় নয় বিত্তশালী এইসব মহার্ঘ্য প্রার্থীরা পেশাদারি উপার্জনের পথেই একেকজন কোটিপতি মানুষ। বাংলার রুখা সুখা জেলা বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বাহার বন পাহাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে থাকা ভীরু ভোটারেরা তাই দূর থেকে এই সব প্রার্থীদের একেকজন ‘লাট সাহেব’ বলেই জানেন,মানেন। অযোধ্যা পাহাড়ের খয়ের বেড়ার বৃদ্ধ শম্ভু সর্দার যেমন বললেন, ‘উয়ারা বাবু লোক। আমরা মুনিশ”। নিসর্গ প্রকৃতি ঘেরা বান্দোয়ান,বাঘমুণ্ডির ময়লা জামা,খালি পায়ের চম্পা সবর,অলকা মান্ডি অথবা বাঁকুড়ার রাণীবাঁধের মাঝ গড়িয়ার ছুটকুন সর্দার, সিংলহরের জনাই বাস্কেরা কখনো নিজের চোখে কোনো সাংসদকে দেখেননি। ধ-জুড়ির দশ ক্লাশের বিমলা সর্দারের অবাক চোখে প্রশ্ন – ‘ওনারা দিল্লিতে থাকেন না? এইখানকার লোক”?
বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের তিন প্রার্থীর দুজন কয়েক কোটি টাকার সম্পদ,ধন সম্পত্তির মালিক। আরেকজন,গরীবের দল সিপিএমের প্রার্থী নীলাঞ্জন দাশগুপ্ত নিজেও ৮০ লাখ টাকার সম্পদের মালিক। তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপি’র প্রার্থী অরূপ চক্রবর্তী,সুভাষ সরকারের সম্পদের পরিমাণ ৪.৯৩ কোটি টাকার ও ১.৩৬ কোটি টাকার। বাঁকুড়া এমনই জেলা,যেখানকার বাসিন্দাদের গড় বার্ষিক আয় ৫৭ হাজার ৮৭৯ টাকা। অর্থাৎ মাসে ৫০০০ টাকার কম। “বাঁকুড়া ফার্স্টবয়দের জেলা। বিগত বহু বছর ধরেই রাজ্যের মাধ্যমিক,উচ্চ মাধ্যমিকে ডজন ডজন ছেলে মেয়ে প্রথম,দ্বিতীয়,তৃতীয় হয়ে আসছে লাগাতার। অথচ…”, আফসোস বাঁকুড়া বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর কথায়, “শিক্ষা-দিক্ষার ওপর তলার এই জেলার সাক্ষরতার হার ৭০.২৬ শতাংশ, আবার, আমাদের গর্বের এই জেলাটাতেই বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে মজুর নিয়োগের অনুপাত ৫১.২১, যা রাজ্যের বহু জেলার চেয়ে ঢের বেশি। কেন এমন”? বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী সৌমিত্র খানের বিষয় সম্পত্তির ঝাঁঝ দেখে চমকে উঠেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও। বিষ্ণুপুরের জনসভায় সৌমিত্র’র সম্পদ বৈভবের ফিরিপ্তি তারই প্রাক্তন স্ত্রী সুজাতা মন্ডলের মুখ দিয়ে, হাতে মাইক ধরে রাজ্যবাসীকে শুনিয়ে দিলেন মমতা। সুজাতার সংযোজন, “সিটি সেন্টারে সম্প্রতি দু’কোটি টাকা দিয়ে আরেকটা বাড়ী কিনেছে সৌমিত্র। ওর মোট ছ’টা বাড়ী আর বহু জমি”। সুজাতাই এবারের ভোটে প্রাক্তন স্বামীর বিরুদ্ধে এই ঘাসফুলের প্রার্থী ছিলেন। রাজনৈতিক, নাকি ব্যক্তিগত রোষেই প্রকাশ্যে খুলে বলে দিলেন তাদের এক সময়ের সুখের সংসারের ‘গোপন কথাটি’!তাদের ‘আরাধ্য’ নেতাদের ঐশ্চর্য’র জমকালো ফর্দ গরীবের ফুটো চালের ভেতর উঁকি দেওয়া আকাশে দেব দর্শনের আরাম এনে দেয়। বৃদ্ধ সানগিরি হেমব্রম। রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে অবসরের পর আদিবাসীদের সংগঠন ‘ভারত জাকাত মাঝি পরগনা মহল’র নেতৃত্ব দিয়েছেন দীর্ঘদিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “একদল মানুষ গরীরের কথা বলে শাসনে এসেছিল। ওদের সরিয়ে তস্য গরীব নির্যাতিতের কথা বলে আরেকদল মানুষ এল। সেভাবে কিছু কি আদৌ বদলালো”? তার আক্ষেপ, “আরেকদল জঙ্গলমহলে ঘুরে ঘুরে কবছর ধরে অনেক কথা শুনিয়ে সরল মানুষের বিশ্বাস খরিদ করে রাজা হলো। ভাল। কিন্তু, মানুষের রুটির কথা বললেই আরো পাঁচ-সতি বুঝিয়ে,পষ্টাপষ্টি ধম্ম কথায় চিড়ে ভেজায়,ভয় দেখায়। মানুষ তবে কোথায় যাবে বলুন দিকি? মঝে মাঝে মনে হয়- এই সব ভন্ডুল করে একটা আলাদা সূর্য কেন ওঠেনা বলুন তো বনপাহাড়ের বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায়”? সানগিরির ভাঙা পাঁজর ফুটে হা হুতাশের মতো বেরিয়ে আসা এই দীর্ঘ্যশ্বাস চাপা পড়ে যায় হবু সাংসদের ঝাঁ চকচকে প্রাসাদ,বাগানবাড়ী আর বিলাসবহুল এস.ইউ.ভি.র মোটা মোটা চাকার তলায়। গরীবের যে মা-বাপও নেই,ঠাকুরও নেই!!